স্বপ্ন কখনো হারায় না :: ল্যারি পেইজ

ইন্টারনেট জগতে সার্চ ইঞ্জিন গুগলের উদ্ভাবক ল্যারি পেইজ একজন আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং ইন্টারনেট উদ্যোক্তা।১৯৯৮ সালে ল্যারি ও তাঁর বন্ধু সার্গেই ব্রিন মিলে গুগলের যাত্রা শুরু করেন। তিনি ২০০৯ সালের ২ মে ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এই বক্তৃতাটি দেন।


* * *
অনেক দিন আগের কথা। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাস। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে বিভিন্ন কাজ থাকত। তারই একটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের রান্নাঘরের দেয়াল ও ছাদ থেকে ময়লা পরিষ্কার করা। আর ওই ময়লা পরিষ্কার করতে গিয়ে মা ও বাবার পরিচয়। সুতরাং আমার আসা সেখান থেকেই। আমার বাবা এই মিশিগানেই কম্পিউটার যোগাযোগ বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। কিন্তু এটা তিনি করেছেন ৪৪ বছর আগে। বাবা ও মা নিজেদের পোশাকগুলো নিজেরাই তৈরি করেছেন। আমার বাবার পোশাক আমি পরেছি, আমার পোশাক আমার ছোট ভাই পরেছে। আরও কত কী!

আমি এগুলো বলছি কারণ, এটাই হচ্ছে আমার এত দূর আসার পথ। আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না যে এখানে আসতে পেরে আমি কতটা গর্বিত।
স্বপ্নপূরণের জন্য আমার একটি গল্প আছে। অথবা সত্যিকারের স্বপ্ন খুঁজে পাওয়ার জন্যই আমার গল্পটি আমাকে সহায়তা করে।

তুমি কি জানো, মধ্যরাতে রঙিন স্বপ্ন দেখে কীভাবে জেগে উঠতে হয়? এবং তুমি কি জানো, তোমার বেডের পাশে কাগজ আর কলম না থাকলে ওই স্বপ্ন তুমি কীভাবে মনে রাখবে?

আমার যখন ২৩ বছর বয়স, তখন এ রকম স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম। হঠাৎ করে যখন আমি জেগে উঠলাম, ‘তখন চিন্তা করছিলাম, আমরা কি পুরো একটি ওয়েব পেজ ডাউনলোড করতে পারি শুধু এর লিংকটা দিয়ে?’

তখনই আমি একটি কলম ও খাতা নিয়ে লেখা শুরু করে দিলাম। মাঝেমধ্যে এভাবে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে জেগে উঠতে হয়। আমি মধ্যরাত পর্যন্ত সময় ব্যয় করেছি চিন্তাভাবনা করতে। আমি আমার উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি ব্যাপারটি নিয়ে। তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তুমি চালিয়ে যাও, তুমি পারবে।’ কখনো চিন্তা ছিল না আমরা একটি ‘সার্চ ইঞ্জিন’ তৈরি করতে পারব। কিন্তু আমাদের চেষ্টা দিয়ে সফল হলাম। এভাবেই গুগলের জন্ম।

যখন আমি মিশিগানে ছিলাম, তখন চিন্তা করতাম, কীভাবে স্বপ্নকে বাস্তবে আনা যায়। আমি বিভিন্ন কর্মশালায় গিয়ে নিজেকেই নিজে অনুপ্রাণিত করেছি। আমি মনে করি, স্বপ্ন কখনো হারায় না। সাময়িকভাবে লুকিয়ে থাকে মাত্র। যদি আমরা কঠোর পরিশ্রম করতে পারি, আর সেই পরিশ্রম যদি কোনো লক্ষ্য ঠিক রেখে করা যায়, তবে সমাধান আসবেই আসবে।

আমি মনে করি, উচ্চাশা সফল করা সম্ভব। সফল করতে অনেক বেশি উত্তেজিত হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু তোমাকে তোমার সঙ্গে মৃদু প্রতিযোগিতা করতে হবে প্রতিনিয়ত। সর্বোচ্চ ভালো মানুষেরা বড় বড় চ্যালেঞ্জের সঙ্গে কাজ করতে চান। যেমনটি গুগলে হয়েছিল। আমাদের উদ্দেশ্য, পৃথিবীর সব তথ্য একত্র ও বিশ্বজনীন করা এবং সহজে যাতে ব্যবহার করা যায়। আমি ও আমার সহযাত্রীরা যখন গুগলে কাজ শুরু করলাম, তখন ভীষণ চিন্তায় ছিলাম, আমার পিএইচডি থমকে না যায়! কিন্তু আমি পিএইচডি সম্পন্ন করেছি। সুতরাং তোমাকে তোমার মূল রাস্তায় থাকতে হবে, তারপর তোমার কাজ। এটা অনেকটা বৃষ্টির সময়ের মতো। মানে, বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটার সময় তোমাকে ছাতার চেয়ে নিচের দিকে খেয়াল বেশি রাখতে হবে; না হলে গর্তে পড়ে তোমার শরীর নোংরা পানিতে ভিজে যাবে।

প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে সবাই অনেকটা অলস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনই উপযুক্ত সময় তোমার আলোড়িত হওয়ার। তুমি কি পারো তা দেখিয়ে দিতে। সুতরাং স্বপ্নে বসবাস করার ইচ্ছে বাদ দিলে চলবে না। কারণ তোমাকে পৃথিবীর দরকার।

কোনো এক সকালে তুমি অনেক আত্মবিশ্বাসী হবে। কিন্তু সৃষ্টির নেশা যদি থাকে, তবে তাকে ভুলে যাওয়া যাবে না। তুমি তোমাকে অন্যের থেকে আলাদা ভাববে এবং মনে করবে, তুমি যে সুযোগ পেয়েছ, কেউ তা পায়নি। সুতরাং তোমাকে এটা শেষ করতে হবে। তোমাকে পার্থক্য করতে হবে অন্যের থেকে তোমার কাজের মাধ্যমে। তারপর তোমার জীবনই তোমাকে বয়ে নিয়ে বেড়াবে।

১৯৯৬ সালের মার্চে বাবা মারা গেলেন। বাবা মারা যাওয়ায় আমি অত্যন্ত হতাশার মধ্যে পড়ি। কিন্তু আমি আমার অস্তিত্বকে খুঁজে পাই বাবার মধ্যে। বাবা বলতেন, ‘আমরা পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। তার মধ্যে এক নম্বর হলো অটোমেশন বা স্বনিয়ন্ত্রিত যান্ত্রিক ব্যবস্থা, দুই. কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, যেখানে শিক্ষা থাকবে অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার মধ্যে। আমাদের একটা অংশকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে বিজ্ঞানের উন্নয়নে, মেডিসিনে এবং শিল্প খাতে, না হলে আমাদের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে। এর মাধ্যমেই একটি জাতির ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবে তার আগামী প্রজন্মকে। যদি আমেরিকার সব যুবক শিক্ষার মধ্যে তাদের খুঁজত, তবে আমেরিকা আরও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতো।

গুগলের যাত্রাপথে অনেক বাধার সম্মুখীন আমরা হয়েছি; কিন্তু আমরা তার সমাধান করে সামনে চলে এসেছি। আমি মনে করি, আমি যতটুকু না পেরেছি, তার চেয়ে বেশি পেরেছে আমার বয়সটা। আমার ওই ২৩-২৪ বয়সটাই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। সুতরাং আমি মনে করি, তোমরা স্বপ্ন দেখো অনেক বড় হওয়ার কিংবা বড় কিছু করার। সঙ্গে সেই স্বপ্ন কীভাবে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায় তার চিন্তা তোমাকেই করতে হবে। আর যদি তা করতে পারো, তবেই তুমিই সাফল্যের গায়ে তিলক আঁকতে পারবে। আর আমি যদি পারি, তোমরাও পারবে। এখন হাতের নাগালে প্রযুক্তির ছোঁয়া। সুতরাং চেষ্টা চালিয়ে যাও। আর চেষ্টা চালাও অনেক ভালো স্বপ্ন দেখতে। যে স্বপ্নের মধ্যে থাকবে তোমাকে আলাদা করার ক্ষমতা।

ল্যারি পেইজ

গুগলের স্বপ্নদ্রষ্টা লরেনস ল্যারি পেইজ ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। লরেন্স "ল্যারি" পেইজ (ইংরেজি: Lawrence "Larry" Page) একজন আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং ইন্টারনেট উদ্যোক্তা। তিনি গুগল এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ২০শে জানুয়ারি, ২০১১ সালে তাকে গুগলের প্রধান নির্বাহী ঘোষণা দেওয়া হয় এবং তিনি ৪ঠা এপ্রিল, ২০১১ থেকে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে, তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ আনুমানিক $১৬.৭ বিলিয়ন। ল্যারি পেইজ মিশিগানের ইস্ট ল্যান্সিংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কার্ল পেইজ ১৯৬৫ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার বাবা ও মা উভয়েই মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন।

ধন্যবাদান্তে : ল্যারির বক্তব্য ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ আলী এই অনুবাদটি প্রথম আলোর স্বপ্ন নিয়ে তে (২০১০) প্রকাশিত হয়েছিল।

No comments:

Post a Comment