ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সালাফিরা হয়ত আগামীতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আবির্ভূত হতে পারে। তবে পশ্চিম ও উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন চলছে তার সাথে সালাফিদের ভূমিকার হিসাব মেলানো সহজ ব্যাপার নয়। আরব পুনর্জাগরণের এক বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ধেকে শুরু করে উত্তর আফ্রিকা হয়ে পশ্চিম আফ্রিকা পর্যন্ত অঞ্চলে সালাফিদের প্রভাব দিনকেদিন বাড়ছে। সৌদি ও কাতারের সালাফি সংগঠনগুলো তাদের নিজ নিজ দেশে এমনকি বহির্বিশ্বেও সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সারা দুনিয়ার সালাফিপন্থিরা এদের সাহায্য-সহযোগিতার উপর ভর করেই চলছে। তাদের এই সহায়তা পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগাল, মালি, নাইজার ও নাইজেরিয়া থেকে শুরু করে উত্তর আফ্রিকার মরক্কো, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া হয়ে পুরা মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ায় মিশর, লেবানন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। এমনকি ইউরোপ ও আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর সালাফি সংগঠনগুলোকেও তারা সাহায্য করছে।
এই সাহায্যের ধরনটাও অনেকটা আদর্শিক ও অর্থনৈতিক। প্রাথমিক পর্যায়ে মূল লক্ষ্য থাকে বই, পত্রিকা, বক্তব্য-বিবৃতি ও মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক বাণি পৌঁছে দেয়া। সালাফিদের সব সংগঠনই তাদের নিজস্ব পত্র-পত্রিকায় ও বই-পত্রে শাস্ত্রের আক্ষরিক অর্থ তুলে ধরার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। বিশেষ করে দৈনন্দিন জীবনে ধর্মের দৃশ্যমান দিক অর্থাৎ ইসলামি নিয়ম-নীতি, আইনশাস্ত্র ও ফিকাহশাস্ত্রের ব্যবহারকেই তারা প্রাধান্য দেয়। এইসব সাহিত্যকে কেন্দ্র করেই মূলত তাত্ত্বিক প্রচারণা চালানো হয়। তাদের বইগুলোতে হালাল-হারাম, পোশাকের ব্যাপারে ইসলামি নীতি, ইবাদতের পদ্ধতি এগুলোই মূল আলোচ্য বিষয় থাকে।
সালাফিদের তাত্ত্বিক প্রচারণা ইতিমধ্যেই বেশ কিছু দেশে সাড়া ফেলেছে। পশ্চিমেও এর দোলা লেগেছে। এমনকি তরুণদের মনেও এর প্রভাব পড়েছে। এর কারন সালাফিরা সব কিছুকেই হালাল ও হারামের মানদণ্ডে ফেলে তরুণদের কাছে ইসলামের এক সহজ বয়ান হাজির করতে পেরেছে। তারা দাবি করে মুসলমানদের অবশ্যই বিরাজমান জাহেলি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে। আর কোন মতেই রাজনীতিতে জড়ানো যাবে না। সালাফিরা মূলত সব কিছুকে হালাল-হারাম, ভাল-খারাপ, মুসলিম-কাফির এই দ্বিমাত্রিক বিভাজনে ভাগ করতে চায়। তাদের এই দ্বিমাত্রিক বিভাজন দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী একদিকে মুসলিম আর অন্যদিকে সারা দুনিয়ার মানুষ। একপক্ষে শুধু ভালোরা আর অন্যপক্ষে খারাপের পতাকাবাহিরা। একে অবশ্য সংরক্ষিত ধর্মীয় পবিত্রতা বনাম জাহেলি রাজনৈতিক তৎপরতার মধ্যে লড়াইও বলা চলে। সব কিছুকেই দ্বিমাত্রিক বিভাজনের মানদণ্ডে বিচার করার এই নীতি গত কয়েক বছরে গণবিচ্ছিন্ন, আত্মরক্ষামূলক ও মুসলিম-কাফির নির্ধারণে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ নির্ভর এক ধরনের ধর্মীয় মনোভাব তৈরী করেছে। সালাফিদের বড় একটা অংশের মনোভাব এই চিন্তাধারা থেকে মোটেও বের হয়ে আসতে পারে নাই। তবে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম আছে। অবশ্য তারাও যে দ্বিমাত্রিক বিভাজন মনোভাব ধারণ করে না তা বলা যাবে না। তবে আত্মরক্ষার চাইতে এরা আক্রমণাত্মক হতেই বেশি পছন্দ করে। এমনকি রাজনৈতিক ময়দানেও তাদের সক্রিয় ভূমিকা লক্ষণীয়। তারা নিজেদের জিহাদি সালাফি হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাত্ত্বিক ও জিহাদি সালাফিদের মধ্যে দৃশ্যমান কোন সাংগঠনিক বা আদর্শিক যোগাযোগ নাই। যদিও রাজনৈতিক ময়দানে জিহাদি সালাফিদের মনোভাবে তাত্ত্বিক সালাফিদের থেকে ভিন্নতা দেখা যায় না। জাহেলি সমাজের সাথে সংঘাতে জড়ানোর সমর্থনে তারাও সেই পুরাতন দ্বিমাত্রিক বিভাজন নীতি সামনে এনে হাজির করে।
তবে গত কয়েক বছরে কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ছে। তাত্ত্বিক সালাফিরাও এখন ধীরে ধীরে রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। অথচ দশকের পর দশক তারা গণতন্ত্রকে কুফরি মতবাদ বলে রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছে। আফগানিস্তানের প্রাচীনপন্থি তালেবানরাও একসময় রাজনীতির ঘোর বিরোধি ছিল। নব্বইয়ের দশকে সৌদি ও আমেরিকার টাকায় তারা রাশিয়ার প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তালেবানদের রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলার পরীক্ষামূলক উদ্যোগটা খুব জরুরি প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের এই সময়ে এসে আমরা এখন সালাফি সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের উত্থান দেখছি। বিশেষ করে মিশর ও তিউনিসিয়ায়। সালাফিরা দক্ষ ও কাজে-কর্মে তড়িৎকর্মা। নিজ নিজ দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে তারা জোরালো ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে।
সালাফি ইসলামের সাথে কাজ করতে আমেরিকা বা ইউরোপের কোন আপত্তি নাই। কারন পেট্রোডলার নির্ভর রাজতন্ত্রে সালাফিদের প্রচারিত তাত্ত্বিক ইসলাম কখনোই পশ্চিমা অর্থনীতির বিরূপ হবে না। যদিও সালাফিরা গণতন্ত্র বা বহুমতের বিরোধী। তারপরও মধ্যপ্রাচ্য বা দুনিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে পশ্চিমাদের ভূকৌশলগত প্রভাব বিস্তারে কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি তাদের নাই। বরং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের পশ্চিমাদের কাছেই হাত পাততে হয়। সালাফিদের এই নির্ভরতার কারনেই পশ্চিমারা তাদের সাথে সন্ধি করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আমেরিকার কাছে সন্ধির জন্য এই ধরনের নির্ভরতাই মুখ্য। সেক্ষেত্রে গণতন্ত্র মানে কি মানে না তা বিবেচ্য নয়।
সৌদি আরব, কাতার বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতে বিদ্যমান সালাফি সংগঠনগুলো স্বাধীন মুসলিম দেশগুলোতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও মিশরে তাদের লগ্নি সবার নজরে এসেছে। আর.এ.এন.ডি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে শুধুমাত্র মিশরের নির্বাচনেই সালাফিরা ৮ কোটি টাকা খরচ করেছে। ওবামা প্রশাসন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো সালাফিদের এইসব বিনিয়োগ সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত আছে। অবাক লাগতে পারে, আদর্শিক বিরোধিতা থাকার পরও কেন পশ্চিমা দেশগুলো ইসলামপন্থিদের নামে বেনামে সাহায্য দিচ্ছে? মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা প্রায় একশ বছর ধরে সক্রিয়ভাবে অবস্থান করছে। বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই অঞ্চলে তাদের অবস্থান ও নজরদারি দুটোই বেড়েছে। এই একশ বছরে আমেরিকা প্রশাসন ও তাদের ইউরোপীয় সহযোগিরা বুঝেছে পেট্রোডলার নির্ভর রাজতন্ত্র ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচারিত সালাফি ইসলাম এই দুই পক্ষের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখার মাধ্যমেই এই অঞ্চলে পশ্চিমাদের স্বার্থ হাসিল সম্ভব।
দুই পক্ষের সাথে সম্পর্ক রাখার সুবিধা মোটা দাগে তিনটি। প্রথমেই বলা যায় পেট্রোডলার নির্ভর রাজতন্ত্র ও সালাফি মতবাদের কাছে সব চাইতে অগ্রগন্য বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও ধর্মীয় গ্রহণযোগ্যতা অর্জন। এরা উভয়েই রাজনৈতিক ও সামজিক ক্ষমতায়ন এবং বিচার ব্যবস্থাকে খুবই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিচার করে। এইসব বিষয়ে তাদের অবস্থানও অনেক কঠোর। কিন্তু অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে তারা অনেক উদার ও পুজিঁবাদি মতবাদের ধারক। বর্তমান জমানার নয়া উদারবাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইসলামি শাস্ত্রের নীতিমালা প্রয়োগে তারা মোটেই আগ্রহী নয়। বরং দিনকেদিন তারা একে আরো দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত বলা যায়, সালাফিদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ায় মুসলিম প্রধান সমাজে বা দেশগুলোতে বিভেদ জিইয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে। সম্ভাব্য বিপ্লবি আন্দোলনগুলোকেও দমিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে। সংস্কারবাদি ইসলামপন্থি, বামপন্থি বা প্রাচীন সূফিবাদে বিশ্বাসীদের আন্দোলন কৌশলগত কারনেই পশ্চিমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সালাফি ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রকে সমর্থন জোগালে এই সব সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে পারে। এতে মুসলিম প্রধান অঞ্চলসমূহে পশ্চিমাদের নিজস্ব একটা অবস্থান তৈরী হবে। আর তা হবে খুব দ্রুত এবং স্বাভাবিকভাবেই। পশ্চিমারা মুসলিম প্রধান অঞ্চলে যুদ্ধের পক্ষপাতি না। কারন যুদ্ধ মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করে দিবে। তার চাইতে ধর্মের ভিত্তিতে তাদের বিভক্ত করে রাখাটাই সব চাইতে মোক্ষম কৌশল। এক্ষেত্রে প্রকৃতিগতভাবেই মুসলিম সমাজে বিদ্যমান বৈচিত্র্যকে পশ্চিমারা বিভেদের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে।
পশ্চিমাদের জন্য তিন নম্বর সুবিধা হচ্ছে, সালাফিদের উত্থান সুন্নিদের ঐতিহ্য ও বিশ্বাসে বিড়ম্বনা তৈরী করছে। সালাফিরা শিয়াদের মুরতাদ মনে করে। সালাফিদের এই বিশ্বাসের কারনে শিয়া-সুন্নি উত্তেজনাও বাড়ছে। শিয়া-সুন্নি বিভেদ মধ্যপ্রাচ্যের জন্য খুবই জটিল একটা বিষয়। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইল ও পশ্চিমাদের ক্রমাগত হুমকি এবং সাম্প্রতিক কালে সিরিয়ার দমন-নিপীড়ণ একে আরো জটিল করে তুলেছে। এই বিভেদের শিকড় অনেক গভীরে পোঁতা। ফিলিস্তিনিদের ন্যয়সঙ্গত প্রতিরোধ সংগ্রামে সারা দুনিয়ার মুসলিমরা এক হলেও তার মাঝেও শিয়া-সুন্নি বিভেদ একটা বড় বাধা। যদিও সালাফিরা ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম নিয়ে খুব একটা সচেতন না। তারপরও সালাফিদের সংখ্যা যত বাড়ছে ততই বিভেদ বাড়ছে। শিয়াদের সাথে সুন্নিদের। আবার সুন্নিদের নিজেদের ভেতরেও।
সালাফি তাত্ত্বিকদের সাথে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কৌশলগত মৈত্রি স্থাপন মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার সব চাইতে মোক্ষম উপায়। যদিও কাজটা পশ্চিমাদের জন্য খুব একটা সহজ না। পেট্রোডলার নির্ভর রাজতন্ত্র ও তাদের ধর্মীয় আদর্শকে রক্ষা করতে গেলে হয়তবা কোন জনপ্রিয় রাজনৈতিক জোট (ধর্মনিরপেক্ষতাবাদি ও সংস্কারবাদি ইসলামপন্থিদের জোট বা জনপ্রিয় ইসরাইল বিরোধী আন্দোলন)-কে বিভক্ত করতে হতে পারে। এত মুসলিম প্রধান দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ ভাঙ্গন ত্বরান্বিত হবে। নতুন মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো এই বিপদ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মুসলিম দেশগুলোতে ধর্মীয় বিষয়াদি দিনকেদিন আরো জটিল হয়ে উঠছে। এই অবস্থায় মুসলিম চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবি, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ঐক্যের মানসিকতা নিয়ে কাজ করা উচিৎ। মুসলিম সমাজে বিরাজমান বৈচিত্র্যগুলোর স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ। তা না হলে আরব বা আফ্রিকান বসন্তের কোন সুফল পাওয়া যাবে না। একদিকে অদৃশ্য শক্তির ইশারায় মুসলিমরা চীন ও ইনডিয়ার বিরুদ্ধে লড়বে। অন্যদিকে তাদের অব্যবস্থাপনা ও দুর্বলতা ইসরাইলকে বাঁচাতে সাহায্য করবে। অথচ নিরস গোপনীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহৃত না হয়ে মুসলিম দেশগুলোর উচিৎ স্বাধীন অস্তিত্ব বাঁচার চেষ্টা করা। যেই ধর্ম ঐক্যের কথা শোনায় তাকে আর কতদিন বিভেদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হবে। এই সিদ্ধান্ত মুসলিমদের নিজেদেরকেই নিতে হবে।
তথ্যসমূহ
অনুবাদ: শাহ্ মোহাম্মদ ফাহিম
লেখাটি সংগ্রহ করা হয়েছে এখান থেকে [ http://imbd.blog.com/?p=662 ]
লেখাটি ২০ মার্চ ২০১২ তারিখে গালফ নিউজে প্রকাশিত হয়।
মূল লেখার লিংক: http://gulfnews.com/opinions/columnists/the-salafist-equation-1.996976
এই সাহায্যের ধরনটাও অনেকটা আদর্শিক ও অর্থনৈতিক। প্রাথমিক পর্যায়ে মূল লক্ষ্য থাকে বই, পত্রিকা, বক্তব্য-বিবৃতি ও মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক বাণি পৌঁছে দেয়া। সালাফিদের সব সংগঠনই তাদের নিজস্ব পত্র-পত্রিকায় ও বই-পত্রে শাস্ত্রের আক্ষরিক অর্থ তুলে ধরার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। বিশেষ করে দৈনন্দিন জীবনে ধর্মের দৃশ্যমান দিক অর্থাৎ ইসলামি নিয়ম-নীতি, আইনশাস্ত্র ও ফিকাহশাস্ত্রের ব্যবহারকেই তারা প্রাধান্য দেয়। এইসব সাহিত্যকে কেন্দ্র করেই মূলত তাত্ত্বিক প্রচারণা চালানো হয়। তাদের বইগুলোতে হালাল-হারাম, পোশাকের ব্যাপারে ইসলামি নীতি, ইবাদতের পদ্ধতি এগুলোই মূল আলোচ্য বিষয় থাকে।
সালাফিদের তাত্ত্বিক প্রচারণা ইতিমধ্যেই বেশ কিছু দেশে সাড়া ফেলেছে। পশ্চিমেও এর দোলা লেগেছে। এমনকি তরুণদের মনেও এর প্রভাব পড়েছে। এর কারন সালাফিরা সব কিছুকেই হালাল ও হারামের মানদণ্ডে ফেলে তরুণদের কাছে ইসলামের এক সহজ বয়ান হাজির করতে পেরেছে। তারা দাবি করে মুসলমানদের অবশ্যই বিরাজমান জাহেলি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে। আর কোন মতেই রাজনীতিতে জড়ানো যাবে না। সালাফিরা মূলত সব কিছুকে হালাল-হারাম, ভাল-খারাপ, মুসলিম-কাফির এই দ্বিমাত্রিক বিভাজনে ভাগ করতে চায়। তাদের এই দ্বিমাত্রিক বিভাজন দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী একদিকে মুসলিম আর অন্যদিকে সারা দুনিয়ার মানুষ। একপক্ষে শুধু ভালোরা আর অন্যপক্ষে খারাপের পতাকাবাহিরা। একে অবশ্য সংরক্ষিত ধর্মীয় পবিত্রতা বনাম জাহেলি রাজনৈতিক তৎপরতার মধ্যে লড়াইও বলা চলে। সব কিছুকেই দ্বিমাত্রিক বিভাজনের মানদণ্ডে বিচার করার এই নীতি গত কয়েক বছরে গণবিচ্ছিন্ন, আত্মরক্ষামূলক ও মুসলিম-কাফির নির্ধারণে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ নির্ভর এক ধরনের ধর্মীয় মনোভাব তৈরী করেছে। সালাফিদের বড় একটা অংশের মনোভাব এই চিন্তাধারা থেকে মোটেও বের হয়ে আসতে পারে নাই। তবে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম আছে। অবশ্য তারাও যে দ্বিমাত্রিক বিভাজন মনোভাব ধারণ করে না তা বলা যাবে না। তবে আত্মরক্ষার চাইতে এরা আক্রমণাত্মক হতেই বেশি পছন্দ করে। এমনকি রাজনৈতিক ময়দানেও তাদের সক্রিয় ভূমিকা লক্ষণীয়। তারা নিজেদের জিহাদি সালাফি হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাত্ত্বিক ও জিহাদি সালাফিদের মধ্যে দৃশ্যমান কোন সাংগঠনিক বা আদর্শিক যোগাযোগ নাই। যদিও রাজনৈতিক ময়দানে জিহাদি সালাফিদের মনোভাবে তাত্ত্বিক সালাফিদের থেকে ভিন্নতা দেখা যায় না। জাহেলি সমাজের সাথে সংঘাতে জড়ানোর সমর্থনে তারাও সেই পুরাতন দ্বিমাত্রিক বিভাজন নীতি সামনে এনে হাজির করে।
তবে গত কয়েক বছরে কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ছে। তাত্ত্বিক সালাফিরাও এখন ধীরে ধীরে রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। অথচ দশকের পর দশক তারা গণতন্ত্রকে কুফরি মতবাদ বলে রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছে। আফগানিস্তানের প্রাচীনপন্থি তালেবানরাও একসময় রাজনীতির ঘোর বিরোধি ছিল। নব্বইয়ের দশকে সৌদি ও আমেরিকার টাকায় তারা রাশিয়ার প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তালেবানদের রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলার পরীক্ষামূলক উদ্যোগটা খুব জরুরি প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের এই সময়ে এসে আমরা এখন সালাফি সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের উত্থান দেখছি। বিশেষ করে মিশর ও তিউনিসিয়ায়। সালাফিরা দক্ষ ও কাজে-কর্মে তড়িৎকর্মা। নিজ নিজ দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে তারা জোরালো ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে।
সালাফি ইসলামের সাথে কাজ করতে আমেরিকা বা ইউরোপের কোন আপত্তি নাই। কারন পেট্রোডলার নির্ভর রাজতন্ত্রে সালাফিদের প্রচারিত তাত্ত্বিক ইসলাম কখনোই পশ্চিমা অর্থনীতির বিরূপ হবে না। যদিও সালাফিরা গণতন্ত্র বা বহুমতের বিরোধী। তারপরও মধ্যপ্রাচ্য বা দুনিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে পশ্চিমাদের ভূকৌশলগত প্রভাব বিস্তারে কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি তাদের নাই। বরং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের পশ্চিমাদের কাছেই হাত পাততে হয়। সালাফিদের এই নির্ভরতার কারনেই পশ্চিমারা তাদের সাথে সন্ধি করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আমেরিকার কাছে সন্ধির জন্য এই ধরনের নির্ভরতাই মুখ্য। সেক্ষেত্রে গণতন্ত্র মানে কি মানে না তা বিবেচ্য নয়।
সৌদি আরব, কাতার বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতে বিদ্যমান সালাফি সংগঠনগুলো স্বাধীন মুসলিম দেশগুলোতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও মিশরে তাদের লগ্নি সবার নজরে এসেছে। আর.এ.এন.ডি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে শুধুমাত্র মিশরের নির্বাচনেই সালাফিরা ৮ কোটি টাকা খরচ করেছে। ওবামা প্রশাসন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো সালাফিদের এইসব বিনিয়োগ সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত আছে। অবাক লাগতে পারে, আদর্শিক বিরোধিতা থাকার পরও কেন পশ্চিমা দেশগুলো ইসলামপন্থিদের নামে বেনামে সাহায্য দিচ্ছে? মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা প্রায় একশ বছর ধরে সক্রিয়ভাবে অবস্থান করছে। বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই অঞ্চলে তাদের অবস্থান ও নজরদারি দুটোই বেড়েছে। এই একশ বছরে আমেরিকা প্রশাসন ও তাদের ইউরোপীয় সহযোগিরা বুঝেছে পেট্রোডলার নির্ভর রাজতন্ত্র ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচারিত সালাফি ইসলাম এই দুই পক্ষের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখার মাধ্যমেই এই অঞ্চলে পশ্চিমাদের স্বার্থ হাসিল সম্ভব।
দুই পক্ষের সাথে সম্পর্ক রাখার সুবিধা মোটা দাগে তিনটি। প্রথমেই বলা যায় পেট্রোডলার নির্ভর রাজতন্ত্র ও সালাফি মতবাদের কাছে সব চাইতে অগ্রগন্য বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও ধর্মীয় গ্রহণযোগ্যতা অর্জন। এরা উভয়েই রাজনৈতিক ও সামজিক ক্ষমতায়ন এবং বিচার ব্যবস্থাকে খুবই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিচার করে। এইসব বিষয়ে তাদের অবস্থানও অনেক কঠোর। কিন্তু অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে তারা অনেক উদার ও পুজিঁবাদি মতবাদের ধারক। বর্তমান জমানার নয়া উদারবাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইসলামি শাস্ত্রের নীতিমালা প্রয়োগে তারা মোটেই আগ্রহী নয়। বরং দিনকেদিন তারা একে আরো দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত বলা যায়, সালাফিদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ায় মুসলিম প্রধান সমাজে বা দেশগুলোতে বিভেদ জিইয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে। সম্ভাব্য বিপ্লবি আন্দোলনগুলোকেও দমিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে। সংস্কারবাদি ইসলামপন্থি, বামপন্থি বা প্রাচীন সূফিবাদে বিশ্বাসীদের আন্দোলন কৌশলগত কারনেই পশ্চিমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সালাফি ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রকে সমর্থন জোগালে এই সব সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে পারে। এতে মুসলিম প্রধান অঞ্চলসমূহে পশ্চিমাদের নিজস্ব একটা অবস্থান তৈরী হবে। আর তা হবে খুব দ্রুত এবং স্বাভাবিকভাবেই। পশ্চিমারা মুসলিম প্রধান অঞ্চলে যুদ্ধের পক্ষপাতি না। কারন যুদ্ধ মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করে দিবে। তার চাইতে ধর্মের ভিত্তিতে তাদের বিভক্ত করে রাখাটাই সব চাইতে মোক্ষম কৌশল। এক্ষেত্রে প্রকৃতিগতভাবেই মুসলিম সমাজে বিদ্যমান বৈচিত্র্যকে পশ্চিমারা বিভেদের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে।
পশ্চিমাদের জন্য তিন নম্বর সুবিধা হচ্ছে, সালাফিদের উত্থান সুন্নিদের ঐতিহ্য ও বিশ্বাসে বিড়ম্বনা তৈরী করছে। সালাফিরা শিয়াদের মুরতাদ মনে করে। সালাফিদের এই বিশ্বাসের কারনে শিয়া-সুন্নি উত্তেজনাও বাড়ছে। শিয়া-সুন্নি বিভেদ মধ্যপ্রাচ্যের জন্য খুবই জটিল একটা বিষয়। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইল ও পশ্চিমাদের ক্রমাগত হুমকি এবং সাম্প্রতিক কালে সিরিয়ার দমন-নিপীড়ণ একে আরো জটিল করে তুলেছে। এই বিভেদের শিকড় অনেক গভীরে পোঁতা। ফিলিস্তিনিদের ন্যয়সঙ্গত প্রতিরোধ সংগ্রামে সারা দুনিয়ার মুসলিমরা এক হলেও তার মাঝেও শিয়া-সুন্নি বিভেদ একটা বড় বাধা। যদিও সালাফিরা ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম নিয়ে খুব একটা সচেতন না। তারপরও সালাফিদের সংখ্যা যত বাড়ছে ততই বিভেদ বাড়ছে। শিয়াদের সাথে সুন্নিদের। আবার সুন্নিদের নিজেদের ভেতরেও।
সালাফি তাত্ত্বিকদের সাথে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কৌশলগত মৈত্রি স্থাপন মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার সব চাইতে মোক্ষম উপায়। যদিও কাজটা পশ্চিমাদের জন্য খুব একটা সহজ না। পেট্রোডলার নির্ভর রাজতন্ত্র ও তাদের ধর্মীয় আদর্শকে রক্ষা করতে গেলে হয়তবা কোন জনপ্রিয় রাজনৈতিক জোট (ধর্মনিরপেক্ষতাবাদি ও সংস্কারবাদি ইসলামপন্থিদের জোট বা জনপ্রিয় ইসরাইল বিরোধী আন্দোলন)-কে বিভক্ত করতে হতে পারে। এত মুসলিম প্রধান দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ ভাঙ্গন ত্বরান্বিত হবে। নতুন মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো এই বিপদ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মুসলিম দেশগুলোতে ধর্মীয় বিষয়াদি দিনকেদিন আরো জটিল হয়ে উঠছে। এই অবস্থায় মুসলিম চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবি, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ঐক্যের মানসিকতা নিয়ে কাজ করা উচিৎ। মুসলিম সমাজে বিরাজমান বৈচিত্র্যগুলোর স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ। তা না হলে আরব বা আফ্রিকান বসন্তের কোন সুফল পাওয়া যাবে না। একদিকে অদৃশ্য শক্তির ইশারায় মুসলিমরা চীন ও ইনডিয়ার বিরুদ্ধে লড়বে। অন্যদিকে তাদের অব্যবস্থাপনা ও দুর্বলতা ইসরাইলকে বাঁচাতে সাহায্য করবে। অথচ নিরস গোপনীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহৃত না হয়ে মুসলিম দেশগুলোর উচিৎ স্বাধীন অস্তিত্ব বাঁচার চেষ্টা করা। যেই ধর্ম ঐক্যের কথা শোনায় তাকে আর কতদিন বিভেদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হবে। এই সিদ্ধান্ত মুসলিমদের নিজেদেরকেই নিতে হবে।
তথ্যসমূহ
অনুবাদ: শাহ্ মোহাম্মদ ফাহিম
লেখাটি সংগ্রহ করা হয়েছে এখান থেকে [ http://imbd.blog.com/?p=662 ]
লেখাটি ২০ মার্চ ২০১২ তারিখে গালফ নিউজে প্রকাশিত হয়।
মূল লেখার লিংক: http://gulfnews.com/opinions/columnists/the-salafist-equation-1.996976
No comments:
Post a Comment