আমাদের সমাজের ব্যর্থ বিয়েগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য ক্যাটাগরি হচ্ছে এই ধরনের বিয়েগুলো। "আমরা সুখী নই, কিন্তু আমরা একই সাথে বসবাস করি"---আমাদের আশেপাশের অধিকাংশ 'ব্যর্থ বিয়ে' এই বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন কারণে অনেক দম্পতি হতাশার সাথে তাদের দুর্বিষহ বিবাহিত জীবনকে টেনে বেড়ায়। তাদের ভেতরে কেউ কেউ সমাজ- লোক লজ্জা-পারিবারিক মর্যাদার কথা ভাবেন। কেউ আবার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা [নিজের ও সন্তানের] চিন্তা করেন, একবার বিয়ে ভেঙে গেলে আবার কে বিয়ে করবে (বিশেষ করে মেয়েরা), বাবা-ভাই যদি না দেখে তাহলে কোথায় যাবে --- এইসব ভেবে শোচনীয় দাম্পত্য জীবন কাটায়।
"আমি জানি আমার মেয়ে খুব কষ্টের ভেতর আছে। তার স্বামী তার ভরণপোষণ করতে চায় না, তাই পেট চালানোর জন্য তাকে কাজ করতে হয়। শাশুড়িসহ শ্বশুরবাড়ির অনেকেই তার সাথে অকথ্য দুর্ব্যবহার করে, বাড়ির সমস্ত কাজ তাকেই করতে হয়। কিন্তু যেখানে ২৫-৩০ বছরের অবিবাহিত-সুন্দরী-উপার্জনশীল মেয়েদের সহজেই পাওয়া যায়। সেখানে আমার মেয়ের এখন ৩৭ বছর; শুধু তাই নয়, তার নিজেরও দুটো মেয়ে আছে। আমি যদি এখন আমার মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসি, তাহলে আবার কার কাছে আমার মেয়েকে বিয়ে দিব? কে তাকে দুই মেয়ে নিয়ে বিয়ে করবে? আর তার মেয়েদেরই বা কি ভবিষ্যৎ হবে?" --- এই ছিল আমাকে বলা এক ভুক্তভোগী বাবার যন্ত্রণাকাতর স্বীকারোক্তি।
একজন সৎ পরামর্শদাতা এই ধরনের পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে সক্ষম। এক বা একাধিক অভিজ্ঞ অথবা প্রফেশনাল উপদেষ্টার আন্তরিক হস্তক্ষেপে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ঝগড়া বিবাদের মীমাংসা হতে পারে। সুরা নিসার পঁয়ত্রিশ নং আয়াতে পারিবারিক কলহ মীমাংসার এক সুন্দর পন্থা বর্ণনা করা হয়েছে, " যদি তাদের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মত পরিস্থিতিরই আশঙ্কা কর, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। যদি তারা উভয়েই মীমাংসা চায় তবে আল্লাহ্ তাদের মিলন সাধনের (অনুকূল) পরিবেশ সৃষ্টি করবেন"। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি দেখা দিলে, বিরোধ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন হবার পর্যায়ে পৌঁছাবার আগেই ঘরে তার সংশোধন ও মীমাংসার চেষ্টা করা উচিত। বেশী লোক জানাজানি বা প্রচার উভয় পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর। এজন্য এই পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্বামী ও স্ত্রীর উভয়ের পরিবার থেকে একজন করে লোক নিয়ে দু'জনের একটি সালিশ কমিটি বানাতে হবে। তারা উভয়ে মিলে বিরোধের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাবেন। তারপর এক সাথে বসে এর সমাধান ও মীমাংসার পথ বের করবেন। স্বামী-স্ত্রী চাইলে নিজেদের আত্মীয়দের মধ্য থেকে নিজেরাই একজন করে লোক বাছাই করে আনতে পারে। আবার উভয়ের পরিবারের বয়স্ক লোকেরা এগিয়ে এসে এ ধরনের সালিশ নিযুক্ত করতে পারে। স্ব-স্ব পরিবার থেকে নির্বাচনের ফলে সালিসকারী ব্যক্তিগণ ছেলে-মেয়ের (স্বামী-স্ত্রীর) দোষ-ত্রুটি, মেজাজ-মর্জি সম্বন্ধে সম্যক ওয়াকেবহাল। সুতরাং তাদের জন্য ন্যায় বিচার ও বিরোধ নিস্পত্তি করা সহজতর হবে।
আয়াতের শেষ অংশটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করুনঃ
"যদি তারা উভয়েই মীমাংসা চায় তবে আল্লাহ্ তাদের মিলন সাধনের [অনুকূল] পরিবেশ সৃষ্টি করবেন"।
এই প্রেক্ষিতে আমি একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে চাই। এই ধরনের একটি সালিশ নিষ্পত্তির জন্য আমাকে একবার নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই তাদের অবস্থানে অনড়, পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব। বিয়ের পর থেকেই ছোটখাট বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য চলতে চলতে সেটা বর্তমানে চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই অনমনীয় এবং 'যত দ্রুত সম্ভব ছাড়াছাড়ি হয়ে যাক' সেটাই চাইছে। আমরা যারা সালিশের কাজে নিয়োজিত ছিলাম তারাও প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে হতাশাগ্রস্থ। এহেন নাজুক পরিস্থিতিতে আমার দাদী সাইয়েদা আব্দুল কারিম নাদিয়াদওয়ালা ঝড়ের বেগে মঞ্চে পদার্পণ করলেন। তিনি বললেন, "তোমরা কোনরকম সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাকে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের সাথে একান্তে কথা বলতে দাও"। স্বামী-স্ত্রী দু'জনে আমার দাদীকে অনুসরণ করে অন্য ঘরে চলে গেল। আমরা অপেক্ষা করছিলাম। কয়েক মিনিট পর তারা তিনজন হাসি হাসি মুখে ফিরে এলো; আমার দাদী আনন্দিত ও রাশভারি মেজাজে ঘোষণা করলেন, "তাদের ভেতর মিটমাট হয়ে গেছে"! এই দম্পতি এখন পর্যন্ত সুখেশান্তিতে ঘর-সংসার করছে। এই ঘটনার পর থেকে বহুবার বিভিন্ন সময়ে আমি আমার দাদীর কাছে জানতে চেয়েছি, "আপনি এমন কি বলেছিলেন, যার ফলে সেই দম্পতির ভেতর এতো দ্রুত মিটমাট হয়ে গেল এবং তারা তালাকের কথা আর মুখেও নিল না?" কিন্তু প্রতিবারই তিনি স্মিত হেসে নীরব থাকতেন। তার দশ বছর পর তিনি যখন শয্যাশায়ী, আমি দাদিকে আবার সেই প্রশ্ন করলাম। এইবার তিনি স্মিত হেসে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, "আমি দু'জনকে কষে দুটো চড় দিয়েছিলাম"!
অধিকাংশ পরিবারে এমন কিছু মুরুব্বী থাকেন যারা ভাঙ্গনের মুখে পতিত পরিবারকে একদম শেষ মুহূর্তে আল্লাহ্র সাহায্যে রক্ষা করতে সক্ষম হন। তবে একটা ব্যপার পাঠকদের পরিস্কারভাবে বুঝতে হবে, সালিশকারীর প্রতি প্রশ্নাতীত ভালোবাসা ও মমতা না থাকলে, শুধুমাত্র চপেটাঘাত করে এই সমস্যার সমাধান করা যায় না। সালিশকারীর অনন্যসাধারণ প্রজ্ঞার সামনে উভয়েই (স্বামী-স্ত্রী) তাদের অনড় ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ অহং থেকে বেরিয়ে এসে নমনীয় ও আপোষের মনোভাব নিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করতে সক্ষম হয়েছিল; ফলশ্রুতিতে আল্লাহ্'তালা তাঁর অসীম করুণায় তাদের জন্য মিলনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে দেন।
[Translated from the book "I want to marry" by Nisaar Yusuf Nadiadwala]
courtesy : Sefat Mahjabeen
No comments:
Post a Comment