মুচি থেকে প্রেসিডেন্ট

দরজায় হেলান দিয়ে কাঁদছেন ২৫ বছরের অসহায় এক যুবক। ১৯৭১ সাল। তাঁর সামনে নিথর পড়ে আছে লক্ষ্মী বউয়ের লাশ। আট মাসের বাচ্চা পেটে ছিল বউটির। না, ঘটনাটি বাংলাদেশের নয়। যুবকটি ব্রাজিলের। হেপাটাইটিসের চিকিৎসার অভাবে ঘরের লক্ষ্মীর অকালমৃত্যু। অপরাধবোধের ঘোর অন্ধকার ছেয়ে ফেলে তাঁকে। জেদ চাপে মনে, একদিন অনেক বড় হবেন, যেদিন এভাবে কাউকে অর্থের অভাবে মরতে হবে না। বেছে নিলেন রাজনীতির পথ। তিনি আজ ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট, লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা! সম্প্রতি টাইম সাময়িকীর বর্ষসেরা শত মনীষীর তালিকায় শীর্ষনেতা নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।


জন্ম ১৯৪৫ সালে। বয়সের ঘর থেকে মুছে গেছে তাঁর ৬৪টি বছর। কিন্তু মুছে যায়নি শৈশব-কৈশোরের কষ্টের স্মৃতিগুলো। তিনি প্রথম পড়তে শেখেন ১০ বছর বয়সে। এরপর চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। সাত বছর বয়সে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এরপর সংসারের আয়রোজগারের দায়িত্ব পড়ে তাঁর ওপর। বন্ধুরা যখন স্কুলে, ১৪ বছরের কিশোর লুলা দা সিলভা তখন রাস্তার মোড়ে বসে আছে রং-পলিশ নিয়ে। কী কাজ তাঁর? পথচারীর জুতা পলিশ। আজকের ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা সেদিন ছিলেন রাস্তার মুচি! কিন্তু এই কাজে কত আর আসে? তাতে তো আর সংসার চলে না। কাজ নিলেন লেদ ফ্যাক্টরিতে। একদিন কাজ করতে গিয়ে তাঁর বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের অর্ধেকাংশ কেটে গেল। কাটা আঙুল নিয়ে দৌড়ে গেলেন আশপাশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার জন্য। ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। কিন্তু সামান্য শ্রমিকের কথা কে শোনে! বিনা পয়সায় তো আর চিকিৎসা হয় না! এই ঘটনা তাঁকে প্রচণ্ড রকম নাড়া দেয়। তাঁর ইচ্ছে হলো, শ্রমিকদের নিয়ে একটা সংঘ গড়ে তুলবেন। এই ইচ্ছেটাই শেষে জেদে পরিণত হয়, যখন বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন তাঁর স্ত্রী মারিয়া। এরপর বড় ভাইয়ের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। ২৭ অক্টোবর, ২০০২। সেদিন তাঁর ৫৭তম জন্মদিন। চারদিকে আনন্দ-আড্ডার আয়োজন। হাজার হাজার মানুষের শুভকামনায় সিক্ত তিনি। না, জন্মদিনের আয়োজন বা শুভকামনা নয়, তিনি নির্বাচিত হয়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট! ২০০৬ সালে তিনি দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আর সে জন্যই টাইম সাময়িকী তাঁকে নির্বাচন করেছে ২০১০ সালের সেরা রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। একজন সাধারণ মুচি থেকে মহানেতা! নিশ্চয়ই লুলা দা সিলভা বিশ্বের সব তরুণের এক আদর্শ অনুপ্রেরণা হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।


সংগ্রহ করা হয়েছে :: প্রথম আলো থেকে

সফল হওয়ার ইচ্ছাটা থাকা চাই :: জে কে রাউলিং

হ্যারি পটার -এর লেখক জে কে রাউলিং। বৃটেনের জে কে রাউলিংয়ের বিশ্বজোড়া খ্যাতি হ্যারি পটার সিরিজের জন্য। ছোটবেলা থেকেই মজার মজার গল্প লিখতেন তিনি, আর সেই গল্পগুলো লেখা শুরু করেছিলেন তাঁর বোনকে পড়ে শোনানোর জন্য। জে কে রাউলিং এখন বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক এবং ব্রিটেনের শীর্ষ ধনী নারীদের মধ্যে ১২তম।

২০০৮ সালের ৫ জুন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন উপলক্ষে তিনি এই বক্তব্যটি দেনঃ

সমাবর্তন উপলক্ষে বক্তব্য দেওয়া বিশাল একটি দায়িত্ব। আমি আমার সমাবর্তনকে মনে করছি। তখন সমাবর্তন স্পিকার ছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক ব্যারোনেস মেরি ভারনক। তাঁর বক্তব্যের প্রতিফলন আমাকে সাহায্য করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আমার লেখায়।


আসলে আমি আমার মন ও হূদয়কে একটি ছকে বেঁধেছিলাম এবং কী শপথ করেছিলাম, তা-ই আজ বলব। আমি আমাকেই জিজ্ঞেস করতাম, কী চাই? ২১ বছরে স্নাতক পাস করেছি, ডিগ্রি অর্জন করেছি, কিন্তু আমি কী শিখেছি আমার শিক্ষাজীবন থেকে? এখান থেকে আমি দুটো উত্তর পেয়েছি। আমাদের একাডেমিক সাফল্য উপলক্ষে যেদিন সবাই একত্র হয়েছিলাম, সেদিন আমি আলোচনা করেছিলাম, আমার সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার মধ্যে আমার লাভ কী? আমার জীবন আর তোমাদের জীবনের মাঝের যে সময়টুকু সেটাই ‘বাস্তব জীবন’। আমি চাই, আমার মতো তোমাদেরও কল্পনার শিখা যেন অনেক উজ্জ্বল হয়।

আমি ফিরে যাচ্ছি আমার ২১ বছর বয়সী জীবনে, যখন সবে গ্র্যাজুয়েশন করেছি। তখন আমি নিজেই আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম। আমি চাইতাম লিখতে, উপন্যাস লিখতে। আমার মা-বাবা দুজনের কেউই কলেজে যাননি। তাঁরা খেয়াল করতেন, আমার উচ্চকল্পনাশক্তি আছে। কিন্তু তাঁরা আশা করতেন, আমি যেন একটি কারিগরি ডিগ্রি অর্জন করি। আর আমি চেয়েছিলাম ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে। আমি তখন একটি সমঝোতায় পৌঁছেছিলাম যে কেউই তার অবস্থানে খুশি নয়। তারপর আমি আধুনিক ভাষা নিয়ে পড়া শুরু করলাম।

আমি মনে করতে পারি না যে আমার মা-বাবা কখনো বলেছেন, আমি ভালো পড়াশোনা করি। আমি যেদিন গ্র্যাজুয়েশন পূর্ণ করি, সেদিনই হয়তো তাঁরা প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন, আমি পড়াশোনা করি। আমি আমার মা-বাবার দৃষ্টিকোণকে দোষ দিই না। যদি তোমার হাতে স্টিয়ারিং থাকে এবং তুমি ভুল পথে যাও, তখন তোমার মা-বাবাকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। কারণ স্টিয়ারিং তো তোমার হাতেই ছিল। আমার মা-বাবা গরিব ছিলেন, ফলে আমিও। তাঁদের সঙ্গে আমি একমত, দারিদ্র্য খারাপ কোনো অভিজ্ঞতা নয়। দরিদ্রতার মধ্যে আছে ভয়-ভীতি, কষ্ট আর হতাশা। এই দরিদ্রতাকে জয় করতে হয় নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে। এটা যখন প্রয়োজন ঠিক তখনই হতে হবে। মনে রাখা উচিত, বোকাদের কাছে দরিদ্রতা রোমাঞ্চকর হতে পারে, তোমার কাছে নয়।

আমি তোমাদের বয়সে ইউনিভার্সিটি থেকে অনেক দূরে একটা কফিশপে বসতাম আমার গল্প লেখার জন্য। ক্লাসেও মনোযোগ দিতাম লেকচারের প্রতি। পরীক্ষায় পাস করার পর প্রতিবছরই আমি আমার সাফল্যের কথা হিসাব করতাম।

আমি জানি, তোমরা এখন প্রাপ্তবয়স্ক, এখন উচ্চশিক্ষিত। তো সেই তোমরা কঠোর পরিশ্রম করতে পারবে না, তা আমি মানি না। বুদ্ধিমত্তা কখনোই ভাগ্যের কারণে ব্যর্থ হতে পারে না এবং আমি এক মুহূর্তের জন্যও তা মনে করিনি। তোমরা হার্ভার্ড থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছ, তোমরা ব্যর্থতার সঙ্গে ততটা পরিচিত নও। সফল হওয়ার ইচ্ছার সঙ্গে ব্যর্থতা সম্পর্কেও তোমাদের একটু হলেও ধারণা থাকা ভালো। প্রকৃত পক্ষে, ব্যর্থতা সম্পর্কে তোমাদের ধারণা আর একজন মানুষের সফলতা সম্পর্কে ধারণা খুব বেশি দূরের নয়।

একসময় আমার জীবনটা অন্ধকারে ছিল। আমার কোনো ধারণা ছিল না, কী হচ্ছে বা কী হতে যাচ্ছে। আমার ধারণা ছিল না, এই অন্ধকারের খালটি কত বিস্তৃত হবে। তবে কেন জানি মনে হতো, একটি দিক থেকে হয়তো আলো আসবে।

আমি নিজের ওপর বিশ্বাসের জোরটাকে বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি আমাকে বোঝাতে চাইতাম, আমি কী। তার পর থেকে আমি সরাসরি আমার শক্তি বা সামর্থ্যকে ব্যবহার করেছি কোনো কাজের ভালো একটা ইতি টানতে। আমি বিশ্বাস করতাম, আমি যেকোনোভাবেই সফল হব। আমার সাফল্য কখনোই কোনো নির্দিষ্ট একটা পথ বেয়ে আসেনি। আমি বিশ্বাস করতাম, আমি সত্যিকার অর্থেই আমার সঙ্গে আছি। আমি নিজেকে মুক্ত করেছিলাম। কারণ আমার ছিল নিজেকে চেনার বিশাল এক ক্ষমতা। আমি বিশ্বাস করতাম আমাকে। আমি আমার নিম্নবিত্ত মা-বাবার মেয়ে ছিলাম। আমার একটি পুরোনো টাইপ রাইটার ছিল এবং এর সঙ্গে ছিল বড় একটা স্বপ্ন। এ বাস্তবতাই আমাকে নতুন করে, সক্ষম করে গড়ে তুলেছে।

আর আমার ছিল কল্পনা করার ক্ষমতা। এটার একটা অংশই আমাকে পুনরায় গড়তে সহায়তা করেছে, কিন্তু পুরোটা নয়। আমি শিখেছি, বিশাল এক অনুভূতির মধ্যে কল্পনার বা কল্পনাশক্তির কী মূল্য। কল্পনাশক্তিই আবিষ্কার আর অনাবিষ্কারের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়। কল্পনাশক্তি যদি প্রবল হয়, তবে সফল হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে, করতে হবে এর যথাযথ ব্যবহার। সবাই পারে না। যারা পারে তারাই সফল। সুতরাং তুমি নিজেই ঠিক করো, তুমি কোন দলে থাকবে।

আমার সফলতম অভিজ্ঞতা হলো হ্যারি পটার। আমি একনাগাড়ে, পর্যায়ক্রমে লিখে গেছি বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আর এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি শুরু হয়েছিল আমার চাকরির শুরুর দিকে। আমি তখন চাকরি করতাম লন্ডনের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদর দপ্তরে আফ্রিকান গবেষণা বিভাগে। অফিসে প্রতিদিন অসংখ্য চিঠি আসত, যেখানে থাকত কী ঘটছে সেখানে, আর ঘটনাগুলো যেন সারা বিশ্ব জানতে পারে। আমি তাদের ভয়ানক ছবি দেখেছিলাম। আমি সেসব মানুষের অত্যাচারের ছবি দেখেছি।

প্রায় প্রতিদিনই আমি মানুষের ওপর মানুষের নির্যাতনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। মানুষ হয়ে তারই স্বজাতি মানুষের ওপর আঘাত করতে কুণ্ঠিত হয় না। এবং এখন পর্যন্ত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকে অনেক কিছু শিখছি, যা এর আগে কখনো শুনিনি, শিখিনি।
যা-ই হোক, আমার সর্বশেষ আশার কথাটি বলছি। আমি যখন ২১ বছরে ছিলাম, তখনকারই কথা। যাদের সঙ্গে আমি গ্র্যাজুয়েশনের দিন একসঙ্গে বসেছিলাম, তাদের অনেকেই আজ তাদের নিজ গুণে মানবসেবা এবং মানুষের জন্য কাজ করছে। অনেকেই শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। তারা অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছে। মানুষের জন্য মৃত্যুভয়কেও হটিয়ে দিয়েছে। আমাদের গ্র্যাজুয়েশনে আমরা প্রচুর আশার মধ্যে আবদ্ধ ছিলাম, যা আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে হয়েছিল। এ রকম কখনোই আর আসবে না।

সুতরাং আজকের দিনে তোমাদের মধ্যে সে রকম বন্ধুত্ব ছাড়া বেশি কিছু থাকার কথা নয় এবং আগামীকাল আমি আশা করি, যদি তুমি আমার একটি শব্দও মনে রাখো, তবে একটু হলেও সাহস পাবে সামনে চলার। যদি এটা গল্পের মতো হয়, তবে এটাই জীবন। সেটা কত দীর্ঘ, তা নয়, কত ভালো এটাই হচ্ছে বিষয়।

ধন্যবাদঃ প্রথম আলো

পরিশ্রম করলেই কেবল ভাগ্য সহায় হয় : জেমস ক্যামেরন

জেমস ক্যামেরন, বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রই নির্মাণশৈলী ও ব্যবসা-সফলতার ক্ষেত্রে ইতিহাস গড়েছে। টারমিনেটর-২ (১৯৯১), টাইটানিক (১৯৯৭) কিংবা অ্যাভাটার (২০০৯)-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।ক্যামেরন ১৯৫৪ সালের ১৬ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৯ সালের ১৮ জুন দেওয়া এক সাক্ষাৎকার :


আমার ছোটবেলা কেটেছে কানাডার ছোট্ট একটা শহরে। শহরের তীরঘেঁষে বয়ে গেছে ছোট্ট একটি নদী, যেখানে আমরা রোজ খেলতাম। নায়াগ্রা জলপ্রপাত ছিল মাত্র চার বা পাঁচ মাইল দূরে। পানির সঙ্গে তাই একটা ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল, যা আমার কাজেও বারবার উঠে এসেছে। মা ছিলেন গৃহিণী, খুব ভালো ছবি আঁকতেন। আর বাবা ছিলেন প্রকৌশলী। মায়ের সঙ্গে জাদুঘর দেখতে যেতাম; তাই যখন থেকে আঁকতে শিখেছি, তখন থেকেই জাদুঘরের বিভিন্ন স্মারকের অবয়ব আঁকতে চাইতাম, সেটা হোক না পুরোনো কোনো যোদ্ধার হেলমেট কিংবা মিসরীয় কোনো মমি। এসব কিছু আমাকে আবিষ্ট করে রাখত। আবার প্রকৌশল চর্চাতেও আকর্ষণ ছিল প্রচণ্ড। হতে পারে বাবার সম্মান ও পছন্দকে ধরে রাখার জন্য এটা একটা চেষ্টা ছিল। কিংবা হতে পারে তা প্রযুক্তির প্রতি একটা ভালোবাসা, যা আমি রক্তের টান থেকে অনুভব করেছি।

শিশু বয়সেই আমি সব সময় কিছু একটা নির্মাণ করতে চাইতাম। ‘চলো বানিয়ে ফেলি একখানা ঠেলাগাড়ি, চাকাগুলো নিয়ে আসো, তুমি সেটা ঠিক করো...।’ যখন পেছনের দিকে ফিরে তাকাই, তখন আমি আজকের এই আমিকেই সেখানে খুঁজে পাই। মনে পড়ে সেই ছোট্টকালে একটা উড়োজাহাজ বানাতে উঠেপড়ে লেগেছিলাম, আজও তো তেমনটিই করছি, পার্থক্য এই যে এটি বানাতে এখন ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ পড়ে যায়।

শিক্ষাজীবনে খারাপ নই, ছাত্র হিসেবে ভালোই ছিলাম। কারণ পুরোটাই ছিল জানার প্রতি আমার সহজাত তীব্র আকর্ষণ। আমি কাউকেই খুশি করার জন্য পড়িনি। কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পড়াশোনাও হয়নি যে কাউকে টপকে ভালো করতে হবে। আমি জানতে চাইতাম, শিখতে চাইতাম—বিজ্ঞান, ইতিহাস, গণিত সবকিছু। অবসর সময়ে শহরের পাঠাগারগুলোয় সময় কেটে যেত আমার। অনেক সায়েন্স ফিকশন পড়েছি, যা বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝের রেখাকে ধীরে ধীরে অস্পষ্ট করে তুলেছে। বই আর লেখকদের অভিনব জগৎ আমাকে অদ্ভুতভাবে টানত। আর্থার ক্লার্ক, জন ভগ্ট, হার্লান এলিসন, ল্যারি নিভেন সবাই আমাকে প্রভাবিত করেছেন।

একাদশ গ্রেডের সময় আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জীববিজ্ঞানের শিক্ষক ম্যাকেঞ্জি ঠিক করলেন আমাদের স্কুলে একটা থিয়েটার বানাবেন। স্কুলে রেসলিং, ফুটবল, বাস্কেটবলের আয়োজন থাকলেও থিয়েটার ছিল না। আমরা নেই থেকেই কাজ শুরু করেছি। দৃশ্য, পেছনের পর্দা, পোশাক সব উপকরণের জোগাড় করতে হয়েছে। তারপর নাটক প্রযোজনা করেছি। পুরোটাই ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। এবং আমরা সফল হয়েছি। নিয়ম মেনে ঠিকঠাকভাবেই এগিয়েছিলাম। আমাদের পুরো প্রকল্পটাই ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। সেটা সম্ভব করেছিলেন ম্যাকেঞ্জি। এটাই তাঁর অভিনব একটি বৈশিষ্ট্য। এ জন্যই আমি মনে করি, জীবনের সঠিক সময় এমন কিছু ব্যক্তিত্বের ভূমিকা অনস্বীকার্য, যাঁরা তোমাকে বদলে দেবে, তোমার ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

আমি কখনোই নিজেকে ঈশ্বরের উপহার মনে করি না। নিজেকে অন্য শিশুদের চেয়ে আলাদা করে দেখারও কিছু নেই। নিজেকে সবার থেকে আলাদা বানিয়ে দেয় চারপাশের পরিবেশ এবং তোমার অভিনব ক্ষমতা। আমি জীবনের ১০টি বছর এমনভাবে কাটিয়েছি, যেখানে আমাকে শুনতে হয়েছে আমি ইডিয়ট কিংবা একটা জোক ছাড়া কিচ্ছু নই। তার পরের ২৫ বছর আমার চেষ্টাটা ছিল শুধু নিজেকে একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে তৈরি করা। সফলতা সেখানে সামান্যই এসেছে। সফল হওয়ার জন্যই কি আমার নিয়তিকে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল? ঠিক বলতে পারব না।

তবে আমি মনে করি, যত পরিশ্রম করবে ততই ভাগ্য তোমার সহায় হবে। দীর্ঘ পথের অর্জনে ‘সুযোগ’ বড় কোনো কিছু নয়। কিন্তু একটি মাত্র সুযোগ সবকিছু বদলে দিতে পারে। তবে সেখানেও ওই সুযোগকে চেনার একটা ব্যাপার আছে, সুযোগ কাজে লাগাতে পারার একটি ক্ষমতার প্রয়োজন আছে। অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তিই সফল হতে পারেননি, কারণ তাঁরা অনেক বেশিই ভেবেছেন এবং খুব সতর্ক ছিলেন, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী হয়ে পা ফেলার ব্যাপারে তাঁরা ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। যদি তোমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস না থাকে, তাহলে সুযোগও তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে।

জীবনের অনেকটা সময় ধরেই বুঝতে পারিনি যে ছবি বানাব, ছবির নির্মাতা হব, বিজ্ঞানকে নিয়েই গভীরভাবে মগ্ন ছিলাম। ছোটবেলার অনেকটা সময় পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করে মাইক্রোস্কোপের পর্দায় খুঁজতাম প্রোটোজোয়া। কখনো টেলিস্কোপে চোখ মেলে নক্ষত্ররাজিতে হারিয়ে যেতাম। আমার চিন্তাভাবনার পরিসরটা ছিল বিজ্ঞানের বিচিত্র দিককে ঘিরেই। আঁকার প্রতি টান সব সময়ই ছিল। পদার্থবিজ্ঞান আর গণিত নিয়ে পড়াশোনার পাঠ শেষ হলো। তারপর এক অসহনশীল শিক্ষকের পাল্লায় পড়ে ক্যালকুলাসের সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ ঘটে। আমি ইংরেজি বিষয়ে মনোনিবেশ করি, কারণ আমি লিখতেও চাইতাম খুব। এ দুই দিকে উদ্ভ্রান্ত পথ চলতে চলতে ২৫-২৬ বছরে আমি ঠিক করি, ছবি বানানো নিয়ে অগ্রসর হব। নিজেকে ভেবেছিলাম ছবি বানানোর কারিগর হিসেবে, পরিচালক হিসেবে নয়। তবুও...

যে ছবিগুলোর তেমন কোনো বাঁধাধরা প্যাটার্ন নেই, সেগুলোই এসে আমার পছন্দের তালিকায় হাজির হয়। আমি দেখেছি, নিয়মকানুন আমার জন্য ঠিক কাজ করে না। ভালো লাগে যেখানে অনেক হাঙ্গামা থাকবে, শব্দ থাকবে, অস্থিতিশীলতা থাকবে—পরিপূর্ণ কিছু নয়। সেখানেই তো নিজেকে উপস্থাপনের সুযোগ মেলে। যদি সবকিছু তোমার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত কিংবা টিপটপ হয়ে থাকে, তবে জাদুকরি কোনো কিছু উপহার দেওয়ার জন্য দরজাটা তো খোলা যায় না। পরিচালকের মন থেকে তো আর মোহনীয় জাদুর স্পর্শটা প্রতিফলিত হয় না, এটা আসে অভিনয় কুশলীর আত্মার মধ্য থেকে। আন্দোলিত হয়েছি উডস্টক, দ্য গ্র্যাজুয়েট, বান এন্ড ক্লাইড, দ্য গডফাদার, স্টার ওয়ারস প্রভৃতি ছবি থেকে।

ছবি বানানোর কথা শুনে পরিবার কখনোই তেমন সন্তুষ্ট হয়নি। বাবা নারাজ ছিলেন, তিনি আসলে আমার ব্যর্থ হওয়ায় অপেক্ষায় ছিলেন, যেই মুহূর্তে তিনি জানাবেন যে আমার আসলে একজন প্রকৌশলী হওয়াই উচিত ছিল। তাঁর পক্ষ থেকে সহয়তা ছিল একেবারে শূন্য। মা অবশ্য অনেক আগে থেকে এ ধরনের সৃষ্টিশীল শিল্পের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। তাই আশ্চার্য এক গতি ছিল সেখানে, যা আমাকে দীর্ঘ সময়েও এ পথ চলতে সাহায্য করেছিল, যদিও তা দেখতে পাওয়া ছিল দুষ্কর।

যখন ছবি বানানো শুরু করলাম তখন মনে মনে কী অর্জন করতে চেয়েছি সেটা নিয়ে বলা কঠিন। আমার মনের মধ্যে তখন অসংখ্য ছবি, ফ্রেম, দৃশ্যের আনাগোনা করছিল। অনেক বেশি বিজ্ঞান কল্পকাহিনির রাজত্ব ছিল সেখানে। ভিন্ন পৃথিবী আর ভিন্ন পরিবেশের জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমার জন্য এটা ছিল কল্পনা কিন্তু পুরোদস্তুর কল্পনাই কি ছিল তা? পুরোটা জীবন আমাকে অনেক অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে। অনেক শিখেছি সেখান থেকে। আজও শিখছি। তবে শেখাগুলোকে নিয়েই আরও মহৎ কিছু তৈরি করার বড় শিক্ষাটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া। টাইটানিক ছবিটি আমার সব শেখাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অসংখ্য শিল্পীর কাজ ছিল সেখানে। সবার কাছে এত প্রভাবিত হয়েছি যে মনে হয়, তাঁদের ছাড়া এতটা সম্ভব হতো না।

যখন তুমি কোনো বৃহৎ ক্ষেত্রে কাজ করবে ও অনেককে নিয়ে তোমার কাজ করতে হবে তখন আত্ম সন্দেহের প্রয়োজন নেই। যদি তোমার কাজ খারাপ হয় তবে তুমি তাঁদের কাছ থেকে সেখানকার ভুলগুলো সম্পর্কে সমালোচনা শুনবে, যদি ভালো হয় তবে তুমি ভালোই শুনবে। অনেকেই তোমার সঙ্গে থাকবেন, যাঁরা তোমাকে পথ এগিয়ে নিয়ে যাবে, তাই সন্দেহের কোনো স্থান এখানে নেই। এমন আবহাওয়াতেই আমরা কাজ করি।

ছবি বানানোর যে বিশাল ক্ষেত্র সেখানে কিছু পদ্ধতি কখনোই পরিবর্তিত হয় না। প্রযুক্তি আর নির্মাণকৌশলের সব ধারাটাই বদলাতে থাকে। এগুলোর বদল দিয়েই ছবির ধারা ভিন্নরূপ ধারণ করে। দৃশ্যপট বদলে যায়। সেখানে সংযোজন ও বিয়োজন ছবির চাওয়াকে সবার সামনে তুলে ধরে। জীবনের ছকটা তো সে রকমই।

অ্যাকাডেমি অব অ্যাচিভমেন্ট থেকে পাওয়া। ১৯৯৯ সালের ১৮ জুন দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশের অনুবাদ: শিখিত সানী
সংগ্রহ করা হয়েছে, প্রথম আলো থেকে

জীবনটাকে নিতে হবে হালকাভাবে :: জেরি ইয়াং

জেরি ইয়াং ইয়াহু!-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ২০০৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের সমাবর্তনে তিনি এই অনুপ্রেরণা মূলক বক্তব্যটি দেন

প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই চ্যান্সেলরকে। সম্মানিত অতিথি, শিক্ষকেরা ও গ্র্যাজুয়েটদের আলোহা (শুভেচ্ছা)! অনেক কঠিন পড়াশোনা শেষ করে, অসংখ্য পরীক্ষা দিয়ে মনেপ্রাণে পড়াশোনা করে, আজ যারা এ পর্যায়ে এসেছে, তাদের সামনে আমাকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে—এর কারণ শুধু এই নয় যে আমি এ এলাকার পুরোনো বাসিন্দা। এর কারণ হলো ইয়াহুর সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা।


১৯৯৪ সালে আমি যখন আমার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তড়িৎ প্রকৌশলের ওপর পিএইচডি গবেষণা করছিলাম, তখনই আমি ইয়াহু শুরু করি। মানে, আমার আসলে পিএইচডি ডিগ্রি নেই। এর পরও আমি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেতে যাচ্ছি আজ কোনো গবেষণা কাজ ছাড়াই! অসাধারণ!

আজ আমাকে ডাকা হয়েছে তোমাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটানোর জন্য। নিজের জীবনের কিছু বিশেষ অভিজ্ঞতা তোমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য। আজ আমি তোমাদের পাঁচটা বিশেষ পরামর্শ দেব।

প্রথমটি হলো: পত্রিকার শিরোনাম দেখেই নিরাশ হবে না


‘বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েই চলেছে’, ‘চাকরির বাজার কমে আসছে অর্থনৈতিক মন্দায়’। তোমরা মনে করছ, এসব হেডলাইন হয়তো আজকের পত্রিকার। কিন্তু আসলে তা না, এগুলো সেই ১৯৯০ সালের কয়েকটি পত্রিকার হেডলাইন। সে সময় আমিও মনের মতো চাকরি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমি মার্ক টোয়েনের একটা কথা কখনো ভুলিনি। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষ সুখী হওয়ার জন্য একেবারে শূন্য থেকে অজানার পথে পাড়ি দেয়।’ একটা বিষয় সব সময় মনে রাখবে তোমরা, তা হলো শূন্য থেকেই অসীমের শুরু হয়। তোমরা বরং একদিক থেকে ভাগ্যবান যে, এই অর্থনৈতিক মন্দার সময় পড়াশোনা শেষ করে চাকরির বাজারে ঢুকছ। এ কারণেই তোমরা সুযোগ পাবে অর্থনীতি পুনর্নির্মাণে অংশগ্রহণ করার।

দ্বিতীয় কথা: জীবনে যা করবে তাই-ই ফেরত পাবে

শুধু মেধা থাকলেই সাফল্য পাওয়া যায় না। সাফল্য পেতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘যেকোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হলে ওই বিষয়ে অন্তত ১০ বছর অথবা ১০ হাজার ঘণ্টা সময় দিতে হবে।’ একজন শিল্পী আর আরেকজন গুণী শিল্পীর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে দেয় কিন্তু এই পরিশ্রমই।

আমি তাইওয়ান থেকে আমার মায়ের হাত ধরে ছোটবেলায় আমেরিকায় এসেছিলাম। ১০ বছর বয়সী আমি তখন শুধু ‘শু’ মানে জুতা কথাটি ইংরেজিতে বলতে পারতাম। কিন্তু আমি মোটেই ভেঙে পড়িনি। আমি অনেক পরিশ্রম করতাম, অনেক বেশি পড়াশোনা করতাম। হ্যাঁ, এটা সত্যি, এর অনেক দিন পর ইয়াহু শুরু করার সময় ভাগ্যের সহায় অবশ্যই পেয়েছিলাম। কিন্তু এই ভাগ্য সহায় হয়েছিল আমার প্রবল পরিশ্রমের কারণেই। সেই সঙ্গে আমার পরিবার ও বন্ধুদের উৎসাহ তো ছিলই। এমনকি আমি যখন আমার মাকে বললাম, আমি আর পিএইচডির গবেষণা করব না, ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপনের একটা কাজ শুরু করব, তখন তিনি আমার এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সন্দিহান থাকলেও কোনো আপত্তি না করে সমর্থন দেন। আর এত বছর পর আমার সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো অভিযোগ করার সুযোগও এখন খুঁজে পান না আমার মা।

তৃতীয় কথা: যত প্রতিকূলতাই আসুক, নিজের কাছে যা ভালো মনে হয়, তাই-ই করো

আমি আর ডেভিড ফ্লিও তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিসের কাজ করছিলাম। আমাদের গবেষণার বিষয় ছিল, কীভাবে কম্পিউটার চিপস আরও শক্তিশালী করা যায়। সে সময়ই আমরা ওয়েব জগৎ সম্পর্কে জানতে পারি। আর সত্যি সত্যিই এর প্রেমে পড়ে যাই। আমরা আমাদের গবেষণার সব কাজ ফেলে রেখে ইয়াহু তৈরিতে লেগে পড়ি।

আমরা কখনো ভাবিনি, একদিন ইয়াহু এত বড় একটা বিজনেস জায়ান্ট হয়ে যাবে। তখন আমাদের এটা ভেবে মজা লাগত যে কত মানুষ আমাদের ইয়াহু ব্যবহার করছে! খুবই ভালো লাগত তখন।

যদি দেখো, কোনো কিছু তোমার ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে, অথচ এটা তোমার সাধ্যের বাইরে হবে, তাহলে একটাই উপদেশ—সেই কাজটি অবশ্যই করো, প্রচুর পরিশ্রম করে হলেও।

চতুর্থ কথা: বাইরের জগৎ সম্পর্কে জানতে হবে

বিশ্ব ভ্রমণ করে যেমন বাইরের জগৎ সম্পর্কে জানা যায়, তেমনি ইন্টারনেটে লগইন করেও তা জানা যায়। পৃথিবী দেখতে হবে, জানতে হবে মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতি সম্পর্কে। সুতরাং বেরিয়ে পড়ো, পৃথিবীটা দেখো। পৃথিবীকে চেনো, পৃথিবীর মানুষকে জানো। মনীষী অগাস্টিন বলেছেন, ‘পৃথিবী হলো একটা বিশাল বই, আর যারা পৃথিবী ঘুরে দেখেনি, তারা এই বইয়ের শুধু একটা পাতা পড়েছে।’

পাঁচ নম্বর কথা: জানার কোনো শেষ নেই


জানার কোনো শেষ নেই—তাই সবকিছু সম্পর্কেই জানতে হবে। যত জানবে জীবনের সফলতার পথে তত এগিয়ে যাবে। আমি কলেজে পড়ার সময় মুঠোফোন ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না। ভাবতেও অবাক লাগে, তখন কীভাবে দিন পার করতাম, পড়াশোনা করতাম! আমার দুটো ছোট মেয়ে আছে। আকাশ কেন নীল, সেটা জানার জন্য ওরা আর আমাকে জিজ্ঞেস করে না। কারণ, এখন ওদের হাতে আছে ইন্টারনেট। দুনিয়া এখন ওদের নখদর্পণে। কোনো কিছু না জানার অজুহাত ওরা আর এখন দিতে পারবে না।

গুপ্তধনের ভান্ডার তোমাদের সামনে! তথ্যপ্রযুক্তি পাল্টে দিচ্ছে দুনিয়াকে। তোমাদের হাতের কাছে কী আছে, সেটা তোমরা বুঝতেই পারছ। তোমরা জানার আগ্রহ কখনো হারাবে না। জানতেই থাকবে, শিখতেই থাকবে।

শেষ এবং সবচেয়ে জরুরি কথা: জীবনটাকে হালকাভাবে নাও


তোমরা কি জানো, ‘ইয়াহু’ নামটা আমরা কোথা থেকে পেয়েছি? যদি ডিকশনারিতে খুঁজে দেখো, তাহলে এর অর্থ পাবে ‘নেতিবাচক অন্য রকম কিছু’। আমি আর ডেভিড ফ্লিও তো আমাদের থিসিসের কাজ ছেড়ে এ রকম কিছুই করছিলাম ইয়াহু তৈরির সময়। তাই আমরা এটার নাম দিয়েছিলাম ‘ইয়াহু!’ এমনকি এখনো আমাদের ইয়াহু অফিসের সাজসজ্জা দেখলে যে কেউ অবাক হবে। একেবারে হালকা চিন্তাভাবনা নিয়ে সাজানো আমাদের অফিস। আমি মনে করি, জীবনটাকে যদি হালকাভাবে নিতে না পারো, তবে তুমি জীবনটাকে নষ্ট করছ।

আজ থেকে তোমাদের নতুন জীবনের পথে যাত্রা শুরু হচ্ছে। সামনের জীবনটা অনেক সুন্দর। কিন্তু তোমাদের মনে নিশ্চয় অনেক জিজ্ঞাসা আর সংশয় রয়েছে। জীবনটা কী, সেটা জানার চেষ্টা রয়েছে। তাহলে তোমাদের বিখ্যাত মনীষী রালফ ওয়ালডো এমারসনের একটা কথা শোনাই, ‘জীবন হলো অনেকগুলো শিক্ষণীয় বিষয়ের সমন্বয়, যে বিষয়গুলো জানতে পুরো জীবন পার করতে হবে।’

তাহলে আর ভাবনা কিসের! জীবন তো অনেক বড়! তোমার দায়িত্ব হলো এই জীবনের অচেনা-অজানা পথে হেঁটে যাওয়া। ভাবনামুক্ত থাকো, শিখতে থাকো, জানতে থাকো। তবে জীবনের এ যাত্রায় তোমার কাছের মানুষদের কথা কখনো ভুলে যেয়ো না। কারণ, তারা জানে তুমি কে, তুমি কী করতে পারো। তুমি তাদের কাছে অনেক কিছু। জীবনের পথে যাদের পাশে পেয়েছ তাদের কখনো ভুলে যেয়ো না।

এবার তাহলে বিদায় জানাই গ্র্যাজুয়েটদের। ভালো থাকো। মাহালো! (ধন্যবাদ)

মূল অনুবাদকঃ . ফয়সাল হাসান – প্রথম আলো

মিশরের প্রেসিডেন্ট মুরসি ক্ষমতা গ্রহণের পর অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন

২৬ জুন ২০১২, বিকেল ০৫:৪৫ 

নির্বাচনে জয়লাভের পর সাধারণত একজন প্রেসিডেন্টের জীবন পাল্টে যায়। আলীশান বাসভবনে থাকার ব্যবস্থা, অফিসে-আদালতে তার ছবি টাঙ্গানো, পথে যাতায়াতের সময় সমস্ত যানবাহন থামিয়ে প্রেসিডেন্টের গাড়ির বহর যায়, আগে যেসব মানুষ কাছাকাছি থাকতেন আর দেখাসাক্ষাত করতেন তারাও প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে পারেন না গার্ডদের কড়াকড়িতে। আগের মানুষ আর প্রেসিডেন্ট মানুষ বদলে যায় অনেক বেশি।

মিশরের ইসলামিক রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রাক্তন নেতা, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডক্টর মুহাম্মাদ মুরসি দ্বায়িত্ব গ্রহণের পরেই এইসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।


তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী আশা-জাগানিয়া যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো হলোঃ

ডক্টর মুরসি বলেছেন তিনি তার বর্তমান বাসভবনেই থাকবেন এবং প্রেসিডেন্টের আলিশান বাসভবনে তিনি ও তার পরিবার উঠবেন না।

প্রেসিডেন্ট মুরসি বলেছেন তার ছবি যেন সরকারী অফিস এবং প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাগানো না হয়।

তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী ইউনিয়ন ও অর্গানাইজেশনগুলো যেন তার প্রেসিডেন্সি উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে অর্থ এবং সময়ের অপচয় না করে।

রিপাবলিকান গার্ডদের মুরসি জানিয়ে দিয়েছেন যে, পথে যাতায়াতের সময় যেন সাধারণ মানুষের পথরোধ করে তাদের কষ্ট দেয়া না হয়। তিনি আর একজন মিশরের জনগণ হিসেবেই চলাচল করতে চান।

বিপ্লবে নিহত মানুষদের পরিবারকে তার দপ্তরে দেখা করতে যেন রক্ষীরা কখনো বাধা না দেয়।




আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ডক্টর মুরসির ভূমিকাও দৃষ্টান্ত স্থাপনকারীঃ

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ মিশরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানালে তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমরা সিরিয়ার সরকারের কাছ থেকে কোন অভিনন্দন গ্রহণ করবো না কারণ এই সরকার সিরিয়ান মিলিটারির প্রতিনিধিত্ব করছে যারা অবিচারে সিরিয়ার হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করছে।

মিশরে নিযুক্ত ইরানের রাস্ট্রদূতের সাথে ডক্টর মুরসি সাক্ষাত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে তাদের জানানো হয় যতদিন ইরান সিরিয়ার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলাবে, ততদিন মিশরের প্রেসিডেন্ট ইরানের সাথে তার এই অবস্থান পরিবর্তন করবেন না।

আত্মপ্রত্যয়ী, চমৎকার আশা-জাগানিয়া একটি শুরু করেছেন মুরসি। দেখা যাক ইসলামি রাজনীতি থেকে ক্ষমতায় যাওয়া এই প্রেসিডেন্ট আগামী সংকটময় দিনগুলোতে কতটুকু করতে পারেন মিশরের রাজনীতিতে।

মধ্যপ্রাচ্যে সালাফি সমীকরণ : তারিক রামাদান

ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সালাফিরা হয়ত আগামীতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আবির্ভূত হতে পারে। তবে পশ্চিম ও উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন চলছে তার সাথে সালাফিদের ভূমিকার হিসাব মেলানো সহজ ব্যাপার নয়। আরব পুনর্জাগরণের এক বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ধেকে শুরু করে উত্তর আফ্রিকা হয়ে পশ্চিম আফ্রিকা পর্যন্ত অঞ্চলে সালাফিদের প্রভাব দিনকেদিন বাড়ছে। সৌদি ও কাতারের সালাফি সংগঠনগুলো তাদের নিজ নিজ দেশে এমনকি বহির্বিশ্বেও সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সারা দুনিয়ার সালাফিপন্থিরা এদের সাহায্য-সহযোগিতার উপর ভর করেই চলছে। তাদের এই সহায়তা পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগাল, মালি, নাইজার ও নাইজেরিয়া থেকে শুরু করে উত্তর আফ্রিকার মরক্কো, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া হয়ে পুরা মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ায় মিশর, লেবানন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। এমনকি ইউরোপ ও আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর সালাফি সংগঠনগুলোকেও তারা সাহায্য করছে।


এই সাহায্যের ধরনটাও অনেকটা আদর্শিক ও অর্থনৈতিক। প্রাথমিক পর্যায়ে মূল লক্ষ্য থাকে বই, পত্রিকা, বক্তব্য-বিবৃতি ও মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক বাণি পৌঁছে দেয়া। সালাফিদের সব সংগঠনই তাদের নিজস্ব পত্র-পত্রিকায় ও বই-পত্রে শাস্ত্রের আক্ষরিক অর্থ তুলে ধরার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। বিশেষ করে দৈনন্দিন জীবনে ধর্মের দৃশ্যমান দিক অর্থাৎ ইসলামি নিয়ম-নীতি, আইনশাস্ত্র ও ফিকাহশাস্ত্রের ব্যবহারকেই তারা প্রাধান্য দেয়। এইসব সাহিত্যকে কেন্দ্র করেই মূলত তাত্ত্বিক প্রচারণা চালানো হয়। তাদের বইগুলোতে হালাল-হারাম, পোশাকের ব্যাপারে ইসলামি নীতি, ইবাদতের পদ্ধতি এগুলোই মূল আলোচ্য বিষয় থাকে।

সালাফিদের তাত্ত্বিক প্রচারণা ইতিমধ্যেই বেশ কিছু দেশে সাড়া ফেলেছে। পশ্চিমেও এর দোলা লেগেছে। এমনকি তরুণদের মনেও এর প্রভাব পড়েছে। এর কারন সালাফিরা সব কিছুকেই হালাল ও হারামের মানদণ্ডে ফেলে তরুণদের কাছে ইসলামের এক সহজ বয়ান হাজির করতে পেরেছে। তারা দাবি করে মুসলমানদের অবশ্যই বিরাজমান জাহেলি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে। আর কোন মতেই রাজনীতিতে জড়ানো যাবে না। সালাফিরা মূলত সব কিছুকে হালাল-হারাম, ভাল-খারাপ, মুসলিম-কাফির এই দ্বিমাত্রিক বিভাজনে ভাগ করতে চায়। তাদের এই দ্বিমাত্রিক বিভাজন দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী একদিকে মুসলিম আর অন্যদিকে সারা দুনিয়ার মানুষ। একপক্ষে শুধু ভালোরা আর অন্যপক্ষে খারাপের পতাকাবাহিরা। একে অবশ্য সংরক্ষিত ধর্মীয় পবিত্রতা বনাম জাহেলি রাজনৈতিক তৎপরতার মধ্যে লড়াইও বলা চলে। সব কিছুকেই দ্বিমাত্রিক বিভাজনের মানদণ্ডে বিচার করার এই নীতি গত কয়েক বছরে গণবিচ্ছিন্ন, আত্মরক্ষামূলক ও মুসলিম-কাফির নির্ধারণে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ নির্ভর এক ধরনের ধর্মীয় মনোভাব তৈরী করেছে। সালাফিদের বড় একটা অংশের মনোভাব এই চিন্তাধারা থেকে মোটেও বের হয়ে আসতে পারে নাই। তবে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম আছে। অবশ্য তারাও যে দ্বিমাত্রিক বিভাজন মনোভাব ধারণ করে না তা বলা যাবে না। তবে আত্মরক্ষার চাইতে এরা আক্রমণাত্মক হতেই বেশি পছন্দ করে। এমনকি রাজনৈতিক ময়দানেও তাদের সক্রিয় ভূমিকা লক্ষণীয়। তারা নিজেদের জিহাদি সালাফি হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাত্ত্বিক ও জিহাদি সালাফিদের মধ্যে দৃশ্যমান কোন সাংগঠনিক বা আদর্শিক যোগাযোগ নাই। যদিও রাজনৈতিক ময়দানে জিহাদি সালাফিদের মনোভাবে তাত্ত্বিক সালাফিদের থেকে ভিন্নতা দেখা যায় না। জাহেলি সমাজের সাথে সংঘাতে জড়ানোর সমর্থনে তারাও সেই পুরাতন দ্বিমাত্রিক বিভাজন নীতি সামনে এনে হাজির করে।

তবে গত কয়েক বছরে কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ছে। তাত্ত্বিক সালাফিরাও এখন ধীরে ধীরে রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। অথচ দশকের পর দশক তারা গণতন্ত্রকে কুফরি মতবাদ বলে রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছে। আফগানিস্তানের প্রাচীনপন্থি তালেবানরাও একসময় রাজনীতির ঘোর বিরোধি ছিল। নব্বইয়ের দশকে সৌদি ও আমেরিকার টাকায় তারা রাশিয়ার প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তালেবানদের রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলার পরীক্ষামূলক উদ্যোগটা খুব জরুরি প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের এই সময়ে এসে আমরা এখন সালাফি সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের উত্থান দেখছি। বিশেষ করে মিশর ও তিউনিসিয়ায়। সালাফিরা দক্ষ ও কাজে-কর্মে তড়িৎকর্মা। নিজ নিজ দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে তারা জোরালো ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে।

সালাফি ইসলামের সাথে কাজ করতে আমেরিকা বা ইউরোপের কোন আপত্তি নাই। কারন পেট্রোডলার নির্ভর রাজতন্ত্রে সালাফিদের প্রচারিত তাত্ত্বিক ইসলাম কখনোই পশ্চিমা অর্থনীতির বিরূপ হবে না। যদিও সালাফিরা গণতন্ত্র বা বহুমতের বিরোধী। তারপরও মধ্যপ্রাচ্য বা দুনিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে পশ্চিমাদের ভূকৌশলগত প্রভাব বিস্তারে কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি তাদের নাই। বরং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের পশ্চিমাদের কাছেই হাত পাততে হয়। সালাফিদের এই নির্ভরতার কারনেই পশ্চিমারা তাদের সাথে সন্ধি করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আমেরিকার কাছে সন্ধির জন্য এই ধরনের নির্ভরতাই মুখ্য। সেক্ষেত্রে গণতন্ত্র মানে কি মানে না তা বিবেচ্য নয়।

সৌদি আরব, কাতার বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতে বিদ্যমান সালাফি সংগঠনগুলো স্বাধীন মুসলিম দেশগুলোতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও মিশরে তাদের লগ্নি সবার নজরে এসেছে। আর.এ.এন.ডি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে শুধুমাত্র মিশরের নির্বাচনেই সালাফিরা ৮ কোটি টাকা খরচ করেছে। ওবামা প্রশাসন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো সালাফিদের এইসব বিনিয়োগ সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত আছে। অবাক লাগতে পারে, আদর্শিক বিরোধিতা থাকার পরও কেন পশ্চিমা দেশগুলো ইসলামপন্থিদের নামে বেনামে সাহায্য দিচ্ছে? মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা প্রায় একশ বছর ধরে সক্রিয়ভাবে অবস্থান করছে। বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই অঞ্চলে তাদের অবস্থান ও নজরদারি দুটোই বেড়েছে। এই একশ বছরে আমেরিকা প্রশাসন ও তাদের ইউরোপীয় সহযোগিরা বুঝেছে পেট্রোডলার নির্ভর রাজতন্ত্র ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচারিত সালাফি ইসলাম এই দুই পক্ষের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখার মাধ্যমেই এই অঞ্চলে পশ্চিমাদের স্বার্থ হাসিল সম্ভব।

দুই পক্ষের সাথে সম্পর্ক রাখার সুবিধা মোটা দাগে তিনটি। প্রথমেই বলা যায় পেট্রোডলার নির্ভর রাজতন্ত্র ও সালাফি মতবাদের কাছে সব চাইতে অগ্রগন্য বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও ধর্মীয় গ্রহণযোগ্যতা অর্জন। এরা উভয়েই রাজনৈতিক ও সামজিক ক্ষমতায়ন এবং বিচার ব্যবস্থাকে খুবই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিচার করে। এইসব বিষয়ে তাদের অবস্থানও অনেক কঠোর। কিন্তু অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে তারা অনেক উদার ও পুজিঁবাদি মতবাদের ধারক। বর্তমান জমানার নয়া উদারবাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইসলামি শাস্ত্রের নীতিমালা প্রয়োগে তারা মোটেই আগ্রহী নয়। বরং দিনকেদিন তারা একে আরো দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

দ্বিতীয়ত বলা যায়, সালাফিদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ায় মুসলিম প্রধান সমাজে বা দেশগুলোতে বিভেদ জিইয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে। সম্ভাব্য বিপ্লবি আন্দোলনগুলোকেও দমিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে। সংস্কারবাদি ইসলামপন্থি, বামপন্থি বা প্রাচীন সূফিবাদে বিশ্বাসীদের আন্দোলন কৌশলগত কারনেই পশ্চিমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সালাফি ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রকে সমর্থন জোগালে এই সব সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে পারে। এতে মুসলিম প্রধান অঞ্চলসমূহে পশ্চিমাদের নিজস্ব একটা অবস্থান তৈরী হবে। আর তা হবে খুব দ্রুত এবং স্বাভাবিকভাবেই। পশ্চিমারা মুসলিম প্রধান অঞ্চলে যুদ্ধের পক্ষপাতি না। কারন যুদ্ধ মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করে দিবে। তার চাইতে ধর্মের ভিত্তিতে তাদের বিভক্ত করে রাখাটাই সব চাইতে মোক্ষম কৌশল। এক্ষেত্রে প্রকৃতিগতভাবেই মুসলিম সমাজে বিদ্যমান বৈচিত্র্যকে পশ্চিমারা বিভেদের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে।

পশ্চিমাদের জন্য তিন নম্বর সুবিধা হচ্ছে, সালাফিদের উত্থান সুন্নিদের ঐতিহ্য ও বিশ্বাসে বিড়ম্বনা তৈরী করছে। সালাফিরা শিয়াদের মুরতাদ মনে করে। সালাফিদের এই বিশ্বাসের কারনে শিয়া-সুন্নি উত্তেজনাও বাড়ছে। শিয়া-সুন্নি বিভেদ মধ্যপ্রাচ্যের জন্য খুবই জটিল একটা বিষয়। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইল ও পশ্চিমাদের ক্রমাগত হুমকি এবং সাম্প্রতিক কালে সিরিয়ার দমন-নিপীড়ণ একে আরো জটিল করে তুলেছে। এই বিভেদের শিকড় অনেক গভীরে পোঁতা। ফিলিস্তিনিদের ন্যয়সঙ্গত প্রতিরোধ সংগ্রামে সারা দুনিয়ার মুসলিমরা এক হলেও তার মাঝেও শিয়া-সুন্নি বিভেদ একটা বড় বাধা। যদিও সালাফিরা ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম নিয়ে খুব একটা সচেতন না। তারপরও সালাফিদের সংখ্যা যত বাড়ছে ততই বিভেদ বাড়ছে। শিয়াদের সাথে সুন্নিদের। আবার সুন্নিদের নিজেদের ভেতরেও।

সালাফি তাত্ত্বিকদের সাথে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কৌশলগত মৈত্রি স্থাপন মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার সব চাইতে মোক্ষম উপায়। যদিও কাজটা পশ্চিমাদের জন্য খুব একটা সহজ না। পেট্রোডলার নির্ভর রাজতন্ত্র ও তাদের ধর্মীয় আদর্শকে রক্ষা করতে গেলে হয়তবা কোন জনপ্রিয় রাজনৈতিক জোট (ধর্মনিরপেক্ষতাবাদি ও সংস্কারবাদি ইসলামপন্থিদের জোট বা জনপ্রিয় ইসরাইল বিরোধী আন্দোলন)-কে বিভক্ত করতে হতে পারে। এত মুসলিম প্রধান দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ ভাঙ্গন ত্বরান্বিত হবে। নতুন মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো এই বিপদ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মুসলিম দেশগুলোতে ধর্মীয় বিষয়াদি দিনকেদিন আরো জটিল হয়ে উঠছে। এই অবস্থায় মুসলিম চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবি, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ঐক্যের মানসিকতা নিয়ে কাজ করা উচিৎ। মুসলিম সমাজে বিরাজমান বৈচিত্র্যগুলোর স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ। তা না হলে আরব বা আফ্রিকান বসন্তের কোন সুফল পাওয়া যাবে না। একদিকে অদৃশ্য শক্তির ইশারায় মুসলিমরা চীন ও ইনডিয়ার বিরুদ্ধে লড়বে। অন্যদিকে তাদের অব্যবস্থাপনা ও দুর্বলতা ইসরাইলকে বাঁচাতে সাহায্য করবে। অথচ নিরস গোপনীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহৃত না হয়ে মুসলিম দেশগুলোর উচিৎ স্বাধীন অস্তিত্ব বাঁচার চেষ্টা করা। যেই ধর্ম ঐক্যের কথা শোনায় তাকে আর কতদিন বিভেদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হবে। এই সিদ্ধান্ত মুসলিমদের নিজেদেরকেই নিতে হবে।

তথ্যসমূহ
অনুবাদ: শাহ্ মোহাম্মদ ফাহিম
লেখাটি সংগ্রহ করা হয়েছে এখান থেকে [ http://imbd.blog.com/?p=662 ]
লেখাটি ২০ মার্চ ২০১২ তারিখে গালফ নিউজে প্রকাশিত হয়।
মূল লেখার লিংক: http://gulfnews.com/opinions/columnists/the-salafist-equation-1.996976

ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রাম

লেখাটি সংগৃহীত। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল রাস্ট্রের ইতিহাস এবং ইতিহাসের ক্রমানুসারে ইসরাইলি বর্বরতার ভয়াবহতা ও তাদের পদক্ষেপগুলোর বর্ণনা অত্যন্ত সুন্দর হওয়ায় এখানে শেয়ার করছি। লিখেছেন খান মুহাম্মদ।

The greatest enemy of knowledge is not ignorance, it is the illusion of knowledge. – স্টিফেন হকিং

এই একটি বাক্যের মধ্যেই এমন অনেক কিছু ফুটে উঠে যা এই বিশ্বায়ন এবং মিডিয়ার যুগে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বায়নের কারণে প্রতিটি দেশ যেমন পরস্পরের সাথে জড়িয়ে পড়ছে, তেমনি মহাশক্তিগুলোর দৌর্দণ্ড প্রতাপে মাফিয়া বা গ্যাং সন্ত্রাসের বদলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জন্ম হচ্ছে। এই সন্ত্রাস এত সুন্দর মুখোশ পরে থাকে যে আমরা তার নগ্ন সম্রাজ্যবাদী এবং ফ্যাসিবাদী রূপটা দেখতে পাই না। মুখোশের আড়ালে থেকে এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অত্যাধুনিক যুগের অভিনব “টেররিজম” তৈরী করে এবং নিজের স্বার্থে সেই টেররিজমকেই লালন করে। এসব অপকর্মে তাদের প্রধান সহকারী হয় মিডিয়া। আধুনিক পুলিশী রাষ্ট্রের সবচেয়ে কার্যকরী হাতিয়ার হচ্ছে মিডিয়া।

"অকুপেশন ১০১” (Occupation 101) প্রামান্য চিত্রটি শুরু হয়েছে স্টিফেন হকিং এর এই উক্তি দিয়ে। ডকুমেন্টারির বিষয় ইসরায়েলের অবৈধ আগ্রাসন এবং ফিলিস্তিন অধিকার। ডক্যুটা দেখার পর জীবনের অধিকাংশ কাজকেই একেবারে অর্থহীন মনে হচ্ছে।
এখান থেকে রেচেল কোরি নামের এক মার্কিন ছাত্রীর কথা জানলাম যে ফিলিস্তিনে গিয়েছিল তাদের দুর্দশার ভাগীদার হতে, ইসরায়েলের আগ্রাসন মার্কিনীদের সামনে তুলে ধরতে। কিন্তু মাত্র ২৩ বছর বয়সে ইসরায়েলী সৈন্যদের হাতে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। সে কোন ওয়ার জোনে থাকতো না, সাধারণ ফিলিস্তিনী শরণার্থী শিবিরই ছিল তার আবাসস্থল। মৃত্যু ফ্রন্টিয়ার ছেড়ে ফিলিস্তিনের কত গভীরে প্রবেশ করেছে তা মার্কিনীরা এতে কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে। রেচেল কোরি নিয়মিত মা-বাবাকে মেইল করে তার অভিজ্ঞতার কথা জানাতো। এমনই একটি মেইলের শেষ লাইন ছিল:

I think it is a good idea for us all to drop everything and devote our lives to making this stop.

অকুপেশন ১০১ দেখার পর ঠিক এ কাজটাই করতে ইচ্ছে করে যদিও একটু পরেই নিজের সীমাবদ্ধতাটা বুঝতে পারি। তৃতীয় বিশ্বের এক কোণায় বসে এই আমার পক্ষে কতটুকুই বা করা সম্ভব। হতাশা ছাপিয়ে তখন কেবল আন্তর্জালের কথাই মনে হয়। ইন্টারনেট ছাড়া আমার ভাব প্রকাশের বা দায়িত্ব পালনের আর কোন উপায় আপাতত আছে কি? না, কিছুই খুঁজে পাই না। তাই কেবল লিখেই যাই আর সান্ত্বনা হিসেবে এর পক্ষে কিছু যুক্তি খুঁজে বের করি- হয়ত এই লেখা পড়ে এমন কেউ উদ্বুদ্ধ হল যার কর্মক্ষমতা আমার চেয়ে বেশি। এভাবে একটা হায়ারার্কি তো কাজ করতে পারে, উঠতে উঠতে সেই সচেতনতা কি আমাদের রাষ্ট্রনেতাদেরও ছুঁয়ে দিতে পারে না! আমরা সবাই যদি বিশ্ব জুড়ে মানবতার দলন সম্পর্কে সচেতন হই তাহলে আমাদের নেতারাও কি কিছুটা সচেতন হতে বাধ্য হবে না। কিংবা এরই মাধ্যমে একদিন কি আমাদের মধ্য থেকে মানবতাবাদী কোন নেতার জন্ম হতে পারে না! হয়তো হবে কিছু, হয়তো হবে না…

অকুপেশন ১০১ মূলত মার্কিন দর্শকদের জন্য বানানো। আমেরিকার সাধারণ মানুষকে মার্কিন মিডিয়ার অপপ্রচার সম্পর্কে সচেতন করে তোলাই এর মূল উদ্দেশ্য। প্রামান্য চিত্রের ধারাবর্ণনা করেছেন Alison Weir নামের এক মার্কিন সাংবাদিক যিনি বেশ কিছুকাল যাবৎ ফিলিস্তিনে কাজ করছেন। তিনি ফিলিস্তিনের প্রকৃত অবস্থা সবাইকে জানানোর জন্য “If Americans Knew” নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। মার্কিন দর্শকদের লক্ষ্য করে ডক্যুমেন্টারি বানানোর কারণটিও সহজে বোঝা যায়: বর্তমানে ইসরায়েলের আগ্রাসন থামানোর প্রধান উপায় তার প্রতি মার্কিন সমর্থন তুলে নেয়া। একটা পরিসংখ্যান থেকে অবাক হয়েছি- ১৯৪৯ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে মোট ৬২.৫ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে, আর ইসরায়েল ছাড়া বাকি পুরো বিশ্বকেও দিয়েছে ৬২.৫ বিলিয়ন ডলার।

১৯৪৯ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলকে মোট ১০৮ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে, অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন দিয়েছে ৬ থেকে ৮ মিলিয়ন ডলার। জায়নিস্ট আন্দোলন সব যুগেই সবচেয়ে পরাক্রমশালী শক্তি থেকে পাওয়া সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে। এই সুযোগ সন্ধানের ইতিহাস শুরু হয়েছে নেপোলিয়নের যুগ থেকে।

সে সময় তুরস্কের উসমানী সম্রাজ্যের মৃত্যু ছিল আসন্ন। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো হা করে তাকিয়ে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দিকে, মৃত উসমানী সম্রাজ্যের কোন অংশ কে নেবে- এই নিয়ে চলছিল প্রতিযোগিতা। সে সময়ই নেপোলিয়ন সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাটি করেন। কিন্তু ওয়াটারলুতে পরাজয়ের কারণে তার সব স্বপ্ন ভেস্তে যায় এবং মঞ্চের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে ব্রিটেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বভাবতই এই নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। তবে বিস্তারিত ইতিহাসে না গিয়ে আমি সরাসরি ফিলিস্তিনে ইহুদী উপনিবেশ স্থাপনের সূচনালগ্নে চলে যাচ্ছি। কারণ পরিকল্পনার সরাসরি বাস্তবায়ন এখান থেকেই শুরু হেয়েছে। এরকম একপাক্ষিক সেটেলমেন্টের ধারণা অনেকের কাছেই অবাস্তব মনে হতে পারে। নেপোলিয়ন থেকে শুরু করে পুরো ইতিহাস বুঝলে সেটা মনে হওয়ার কোন কারণ নেই। কারণ রাজনীতির গাণিতিক চালেই সবকিছু হয়েছে। ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে আমার প্রথম লেখায় ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত পাঠ থাকছে যা ক্ষেত্রবিশেষে “অকুপেশন ১০১” প্রমাণ্য চিত্রটির অনুলিখন।

ফিলিস্তিনে ইহুদী উপনিবেশের ইতিহাস

শুরুটা উনবিংশ শতকের শেষার্ধ থেকে। এ সময়ই ইউরোপে এন্টি-সেমিটিজম তথা ইহুদীবিদ্বেষ দানা বাঁধতে শুরু করে। আর ইহুদীরা নিজেদের একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে শুরু করে। তাওরাতের প্রতিজ্ঞা মতে ফিলিস্তিনেই সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। তাওরাতে কোথাও বলা নেই যে, ফিলিস্তিনে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ইহুদীদের জন্য আবশ্যক। শুধু এ ব্যাপারে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতির কথা আছে। কারণ খুব স্বাভাবিক, পয়পম্বর মূসা মিশর থেকে বনি-ইসরাইলদের বের করে নিয়ে এসেছিলেন ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যেই, যদিও তার জীবদ্দশায় সে প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়ে উঠেনি। পয়গম্বর যীশুর সময় জেরুজালেমে ইহুদী রাজত্বই ছিল, খ্রিস্টান ধর্মমতে ইহুদীরাই যীশুকে শূলে চড়িয়েছিল। কিন্তু খলিফা উমরের রাজত্বকালে মুসলিমরা জেরুজালেম দখল করে এবং এখানে মুসলিম সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য পয়গম্বর মুহাম্মাদের সময় মদীনা থেকেও ইহুদীদের বিতাড়িত করা হয়।

প্রায় সহস্র বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ইহুদীরা বিতাড়িত ও ক্ষেত্রবিশেষে নির্যাতিত হলেও যেকোন যুক্তিবাদী মানুষ নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, এন্টি-সেমিটিজমের উত্থানের যুগে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের কোন অধিকারই ছিল না। আমেরিকার সব মানুষই তো ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগাল থেকে এসেছে। তাই বলে এখন তো তারা এসব দেশে ফিরে যাওয়ার দাবী করতে পারে না। ১৮৭৮ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ফিলিস্তিন মোটামুটি সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে বিরাজ করছিল এবং সেখানে মুসলিম ও খ্রিস্টানরা বেশ শান্তিতে বাস করছিল। সামান্য ইহুদীও ছিল। ১৮৭৮ সালে ফিলিস্তিনে জনসংখ্যার পরিসংখ্যান এরকম:

মোট জনসংখ্যা – ৪৬২,৪৬৫
আরব মুসলিম এবং খ্রিস্টান – ৯৬.৮%
ইহুদী – ৩.২%

কিন্তু নেপোলিয়নীয় নীতির অনুসারী ব্রিটিশদের সহায়তায় ইহুদীরা বেশ দ্রুত ফিলিস্তিনে উপনিবেশ স্থাপন শুরু করে। জাহাজে করে একেকবারে হাজার হাজার ইহুদীকে ফিলিস্তিনে আনা হয়, ঘরবাড়ি করে থাকার জন্য তাদেরকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেয়া হয়। সবাই জানেন, ইহুদীদের আর যাই হোক অর্থের সমস্যা নেই। এদের মধ্যে অনেকে আরবদের কাছ থেকে জমি কিনে নেয়, অনেকে জোরপূর্বক মুসলিম ও খ্রিস্টানদের ঘরবাড়ি দখল করে নেয়। ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সহায়তার মূল কারণ ছিল- উসমানী খিলাফতের অধীনে থাকা ভূখণ্ডের ভাগ-বাটোয়ারা করার সময় মিশরকে নিরস্ত্র রাখা। ফিলিস্তিন ছিল মিশর নামক বোতলের ছিপি। ব্রিটিশরা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিল- এই ছিপি আটকে না দিলে মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ-বাটোয়ারাতে জাতীয়তাবাদী মিশরীয়রা বাগড়া দেবে। উপনিবেশের স্রোতে ভেসে আসা ইহুদীদের পরবর্তী পরিসংখ্যান লক্ষ্য করা যাক- ১৯২২ সালের পরিস্থিতিটা এরকম:

মোট জনসংখ্যা – ৭৫৭,১৮২
আরব মুসলিম এবং খ্রিস্টান – ৮৭.৬%
ইহুদী – ১১%

পরবর্তী পরিস্থিতির সাথে তুলনা করলে এই উপনিবেশ হারকেও কম বলতে হয়। আসলে ১৯৩৩ সালে হিটলারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের পূর্ব পর্যন্ত মাথা ঠাণ্ডা রেখেই ইহুদী উপনিবেশের কাজ চলছিল। ১৯৩১ সালের পরিসংখ্যান:

মোট জনসংখ্যা – ১,০৩৫,১৫৪
আরব মুসলিম এবং খ্রিস্টান – ৮১.৬%
ইহুদী – ১৬.৯%

এই প্রথম মানচিত্রের মাধ্যমে মুসলিম ও ইহুদীদের আবাসস্থল দেখাচ্ছি। প্রামাণ্য চিত্রটি থেকে স্ন্যাপশট নিয়েই এটা তৈরী করেছি:




1931

বলাই বাহুল্য হিটলারের অমানবিক ও সাইকটিক এন্টি-সেমিটিজম সব ইহুদীদেরকে ইউরোপ ত্যাগে বাধ্য করে। হিসাব খুব সোজা- বাঁচতে চাইলে ইউরোপ ত্যাগ নয়তো হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাশবিক মৃত্যুবরণ। এই সুযোগে জায়নিস্টরা ফিলিস্তিনে ইহুদী উপনিবেশ দ্রুত বাড়াতে শুরু করে। পরিসংখ্যানই তা বলে দেয়। বিভিন্ন সময়ে ফিলিস্তিনে আসা ইহুদী অভিবাসী তথা উপনিবেশ স্থাপনকারীদের পরিসংখ্যান এরকম:

১৮৮২-১৯১৪ সালের মধ্যে – ৬৫,০০০
১৯২০-১৯৩১ – ১০৮,৮২৫
১৯৩২-১৯৩৬ – ১৭৪,০০০
১৯৩৭-১৯৪৫ – ১১৯,৮০০

অর্থাৎ ১৯৩২ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে উপনিবেশ স্থাপনের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এসময় পুরো বিশ্বের সহানুভূতি ছিল ইহুদীদের প্রতি। কিন্তু আজ পর্যন্ত অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী ও মানবতাবাদী সমাজকর্মী বলতে বাধ্য হয়েছেন- “হলোকস্ট তো হিটলার করেছে। এতে ফিলিস্তিনীদের তো কোন দোষ ছিল না। তাহলে ক্ষতিপূরণটা তাদেরকে দিতে হলো কেন?”
মানবিক দিক থেকে এটা খুব অযৌক্তিক মনে হলেও স্বীকার করতে সমস্যা নেই, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তথা রাজনীতির ময়দানে এটা খুব স্বাভাবিক। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়- উনবিংশ শতক থেকে ফিলিস্তিনীদের শরণার্থী বানানোর যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলে আসছে সে সম্পর্কে ফিলিস্তিনীরাও সচেতন হয়ে উঠতে পারেনি। আর এই স্থান নিয়ে যেকোন আন্তর্জাতিক চুক্তি করার সময় প্রকৃত মালিক তথা ফিলিস্তিনীদের কোন মতামতই নেয়া হয়নি।

যাহোক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনের বদলে পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। আমেরিকার ইহুদীরা এবার বিশ্ব মানচিত্র নকশায় নিজেদের অবদান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। কারণ তারা নিজেদের অপরাধী ভাবতে শুরু করেছিল- তাদের সতীর্থ ইহুদীরা ইউরোপ জুড়ে গণহত্যার শিকার হল তারা আমেরিকায় বসে অঢেল বিত্ত-বৈভবের বিলাসে ডুবে রইল। এই অপরাধবোধ থেকে তারা হোটেল বাল্টিমোরকে ঘিরে তুমুল লবিং শুরু করে। ফ্রাংকলিন রুজভেল্টই নির্বাচনে প্রথমবারের মত ইহুদী লবির সাহায্য নিয়েছিলেন। তার উত্তরসূরী ট্রুম্যান সে পথ ধরেই ইহুদীদের জাতীয় রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ শুরু করেন। আসলে এ সময়ই আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী লবি AIPAC গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অবশেষে এই জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয় জাতিসংঘকে (জাতিসংঘ বলতে তো পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর বিশ্বপরিকল্পনাকেই বোঝায়)। জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে ঐতিহাসিক “দুই জাতি সমাধান” প্রস্তাব করে। তারা প্রাচীন ফিলিস্তিনকে দুই ভাগ করে দুটি দেশ তৈরীর কথা বলে- একটি ইসরায়েল আরেকটি ফিলিস্তিন। এই বিশ্বপরিকল্পনায় ফিলিস্তিনী মুসলিম ও খ্রিস্টানদের প্রতি কেমন অবিচার করা হয়েছে তা নিচের মানচিত্র দেখলেই আশাকরি পরিষ্কার হয়ে যাবে:




1948

এমনকি সবচেয়ে উর্বর জমিগুলো ইহুদীদের দেয়া হয়েছিল। এই দুই জাতি সমাধানও যদি ইসরায়েল মেনে নিতো তাহলেও মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার একটা হিস্যা হতো। যদিও আমি স্বীকার করি- আমি ফিলিস্তিনী হলে কখনও এই অসম বণ্টন মেনে নিতাম না। আশ্চর্যের বিষয় ১৯৯৩ সালে ইয়াসির আরাফাত এর থেকেও একটি বাজে সমাধান মেনে নিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

কথা হলো, ইসরায়েল এটাও মানতে পারেনি। তারা তখনই নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে ফেলেছে- “আমাদের পুরো ফিলিস্তিন চাই, ফিলিস্তিনকে আমরা ইসরায়েল হিসেবে দেখতে চাই এবং একে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাই”। রাজনীতির গণিত অনুসারে ইসরায়েলের এই নীতিকে যুক্তরাষ্ট্রের মেনে নেয়ার কথা। কারণ মধ্যেপ্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক একটি দেশ থাকলেই কেবল সেখানকার অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ ভোগের চিন্তা করা যায়। তাই ১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল পুরো ফিলিস্তিন দখল করে নেয়ার জন্য আগ্রাসন শুরু করে তখন আমেরিকা সহ পশ্চিমা প্রায় সবগুলো শক্তিই নীরবে সবকিছু দেখে যায়।

শুরু হয় “১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ”। এখানে আরব বলে বোধহয় ইসরায়েলীদেরই অপমান করা হল। কারণ আরবরা ফিলিস্তিনীদের নির্বিচারে হত্যা দেখার অনেক পরে সাড়া দিয়েছে। ইহুদীরা ফিলিস্তিনের বেশ কয়েকটি গ্রামে গণহত্যা চালিয়েছে। সবচেয়ে বড় গণহত্যা ঘটেছিল দাইর ইয়াসিন গ্রামে। এই গ্রামের ৬০০ জনের মধ্যে ১২০ জনকেই তাৎক্ষণিকভাবে হত্যা করেছিল ইসরায়েলী সৈন্যরা। যাহোক দেরিতে হলেও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর টনক নড়ে। ফিলিস্তিনের সীমান্তবর্তী মিশর, জর্ডান এবং সিরিয়া যুদ্ধে যোগ দেয়। অন্যান্য কয়েকটি আরব দেশও ফিলিস্তিন রক্ষায় এগিয়ে আসে। আমার মনে হয় না সে সময়ও আরবরা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের যে ক্ষতি হবে তা বুঝতে পেরেছিল। একটি রাষ্ট্রকে যুদ্ধে টেনে আনার জন্য ভ্রাতৃত্ব যথেষ্ট নয়, এখানে রাজনৈতিক চালের অবদান আছে যেটার অভাব সেই মধ্যপ্রাচ্যে প্রকট ছিল। তারপরও কিছুটা লাভ হয়েছে মিশরের যোগদানে। কারণ দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র মিশরই সবদিক গুছিয়ে বিশ্বমানচিত্রে নিজের আসন প্রমাণের উপযোগী অবস্থা পৌঁছেছিল। কিন্তু পুরো যুদ্ধ জুড়ে ইসরায়েলীদের আধিপত্য বজায় থাকে। সৈন্যের পরিসংখ্যান দেয়াই এক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে:

আরব সৈন্য – ৬৮,০০০
ইসরায়েলী সৈন্য – ৯০,০০০

ইসরায়েলের প্রত্যেক যুবকের যুদ্ধ করা বাধ্যতামূলক ছিল। তারা ফিলিস্তিনের ৫০০ টি গ্রামের মধ্যে ৪০০ টিকেই জনশূন্য করে ফেলেছিল। যুদ্ধ শেষে তাই পুরো ফিলিস্তিন অধিকারে তাদের খুব একটা বাঁধা ছিল না। ফিলিস্তিনের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হয়েছিল। পুরো ফিলিস্তিনটা ছিল এক শরণার্থী শিবির। ফিলিস্তিনে এমন একটা পরিবারও বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না যারা কমপক্ষে দুই বার নিজ বাসস্থান থেকে বিতাড়িত হয়নি। ১৯৪৮ সালেই ইসরায়েল নিজেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে এবং মধ্যপ্রাচ্য, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এমন কিছু দেশ বাদে সবাই তাকে স্বীকৃতি দেয়। এই যুদ্ধের পর ফিলিস্তিন বলে পৃথিবীতে আর কোন দেশের অস্তিত্ব থাকে না। ইসরায়েল নামে একটি স্বাধীন দেশ হয়, ফিলিস্তিনের যে অংশটুকু তারা দখল করতে পারেনি সে অংশ মিশর এবং জর্ডান ভাগাভাগি করে নেয়। গাজা উপত্যকা মিশরের অধীনে আসে, জর্ডান পায় পশ্চীম তীর। মানচিত্র দেখা যাক সে সময়কার ফিলিস্তিনকে:






1948

এতেও ইসরায়েলের খায়েশ মেটে না। সবার চোখের সামনে ফিলিস্তিনী উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ১৯৫৭ সালের পর ৪০০,০০০ ফিলিস্তিনী বাস্তুহারা হয় যাদের অর্ধেক ইতিমধ্যেই শরণার্থী ছিল। বাস্তুহারাদের অনেকেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয় একটু ঠাই পাবার জন্য। উল্লেখ্য যুদ্ধপরবর্তী ইসরায়েলের মধ্যেও তখন অনেক ফিলিস্তিনী বাস করতো। এদের প্রায় সবাই বাস্তুহারা হওয়ার পর ইসরায়েল গাজা এবং পশ্চিম তীরের দিকে নজর দেয়। মিশর এবং জর্ডানের কাছ থেকে এ অংশ দুটো কেড়ে নেয়ার জন্য আবার যুদ্ধ শুরু করে। এভাবেই “১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ” শুরু হয়। এই যুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিনের (থুক্কু ইসরায়েলের) মানচিত্র দাড়ায় এরকম:




1967

হল তো এবার। ১৯৬৭ সালেই পুরো ফিলিস্তিন ইসরায়েলের অধিকারে চলে আসল। কিন্তু জায়নিস্টরা জানতো- ক্ষমতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। এজন্য দরকার ছিল, ফিলিস্তিনীরা যাতে কোনভাবেই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখা। ইসরায়েলীরা ঠিক এ কাজটাই করে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগে জেরুজালেমের দুই ভাগ ছিল- পশ্চিম জেরুজালেম ছিল ইসরায়েলের রাজধানী। আর পূর্ব জেরুজালেম ছিল জর্ডান অধিকৃত পশ্চিম তীরের রাজধানী। এ সময়ই ইয়াসির আরাফাতদের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনীদের আন্দোলন জোরেশোরে শুরু হয় এবং তারা পূর্ব জেরুজালেমকেই নিজেদের রাজধানী হিসেবে দেখতে থাকে। উল্লেখ্য ঐতিহাসিক “বায়তুল মুকাদ্দাস” এই পূর্ব জেরুজালেমেই অবস্থিত।

ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে যেন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হতে না পারে সেজন্য ইসরায়েল গাজা এবং পশ্চিম তীরের অভ্যন্তরে অসংখ্য সামরিক চেকপোস্ট স্থাপন করে। প্রথমে গাজা উপত্যকার ছবি দেখা যাক। এখানে যে ইহুদী বসতিগুলো দেখা যাচ্ছে ২০০৫ সালে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। পশ্চিমা মিডিয়া ইসরায়েলের এই বদান্যতা রসিয়ে রসিয়ে প্রচার করে। যেন তারা নিজেদের জায়গা জমি ছেড়ে দিচ্ছে ফিলিস্তিনীদের জন্য। এখনও গাজা উপত্যকার সব গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে মোড়ে ইসরায়েলী চেকপোস্ট আছে। এক গ্রামের মানুষ আরেক গ্রামে যেতে পারে না, কেউ তাদের অন্য গ্রামের আত্মীয়দের সাথেও দেখা করতে পারে না।






1967

পশ্চিম তীরের অবস্থা আরও খারাপ। বলা যায় পুরো পশ্চিম তীরই ইসরায়েলী বসতিতে ছেয়ে গেছে। সবগুলো রাস্তা তাদের করা এবং রাস্তার মাধ্যমে তারা মূলত ফিলিস্তিনী গ্রাম-শহর পৃথিকীকরণের কাজই করছে।






1967

পরিস্থিতি দেখে সহজেই বোঝা যায়, ইসরায়েলীরা চাচ্ছে সব ফিলিস্তিনী জায়গা জমি ছেড়ে চলে যাক। অকুপেশন ১০১ এ একজন ইহুদী বিশেষজ্ঞ জোড় দিয়েই এই কথাটি বলেছেন। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের জনক নোম শমস্কিকেও (MIT অধ্যাপক) এ কথা বলতে শুনলাম। নোম শমস্কি প্রামাণ্য চিত্রটির দুই স্থানে কথা বলেছেন।

এ প্রসঙ্গে এডওয়ার্ড সাইদের কথাও এসে যায়। তার “দি এন্ড অফ দ্য পিস প্রসেস” বইয়ে পড়েছিলাম- ইয়াসির আরাফাত ১৯৯৩ সালে “অসলো চুক্তি” স্বাক্ষর করে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু নোবেল ছাড়া এই চুক্তির আর কোন ফলাফল নেই। অসলো চুক্তির মাধ্যমে আরাফাত ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ইসরায়েল তার কথা রাখেনি। প্রামাণ্য চিত্রটিতে দেখলাম, এই চুক্তি যে বছরগুলোতে কার্যকর ছিল তখনই ফিলিস্তিনে সবচেয়ে বেশি উচ্ছেদ কার্যক্রম চলেছে। বুলডোজার দিয়ে ফিলিস্তিনীদের বাড়িঘর গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সেখানে সরকারী অর্থায়নে বিলাসবহুল উপনিবেশ তৈরী করা হয়েছে, ইহুদীদের সেখানে নিয়ে আসা হয়েছে। এমনকি আসার বিনিময়ে তাদেরকে অগ্রীম অর্থও দেয়া হয়েছে। সাইদ নিজেই ম্যান্ডেলার সাথে তুলনা দিয়ে আরাফাতের অক্ষমতা তুলে ধরেছিলেন।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পুরোটা সময় নেলসন ম্যান্ডেলা নিজ নীতিতে অটল ছিলেন। একবারের জন্যই নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেননি, কারও কাছে মাথা নত করেননি, কোনরকম ফালতু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেননি। আর ইয়াসির আরাফাত যাত্রা শুরু করেছিলেন লেবাননে, সশস্ত্র বিপ্লবী হিসেবে। তখন তার একমাত্র দাবী ছিল পুরো ফিলিস্তিন নিজেদের অধিকারে আনা। সেখান থেকে নড়তে নড়তে শেষে এসে তিনি অসলো চুক্তি করলেন, স্বাধীনতার আশা না দেখা সত্ত্বেও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেন। নেতৃত্বের অভাবও ফিলিস্তিনে প্রকট।

ইতিহাসের এই পাঠ গ্রহণের পর ফিলিস্তিনীদের কোন কাজকেই অনৈতিক মনে হয় না। তাদের আত্মঘাতী বোমা হামলাকেও খুব মানবিক কাজ মনে হয়, “প্যারাডাইস নাউ” সিনেমার তাৎপর্য বুঝতে পারি। ফিলিস্তিনীরা সহ্য করতে করতে অবশেষে ১৯৮৭ সালে জ্বলে উঠেছিল। শুরু হয়েছিল “প্রথম ইন্তিফাদা”। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এটা কার্যকর ছিল। এর পর অসলো চুক্তি হল। চুক্তির সর্বাঙ্গীন ব্যর্থতা ফিলিস্তিনীদেরকে আবার জ্বালিয়ে তোলে। ২০০০ সালে শুরু হয় “দ্বিতীয় ইন্তিফাদা” যাকে অনেক সময় আল-আকসা ইন্তিফাদাও বলা হয়। ২০০৮ সালে এটাও শেষ হয়েছে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ফিলিস্তিনে মৃতের সংখ্যা বরাবরের মত ইসরায়েলীদের ৪ গুণই থেকে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদায় নিহতের পরিসংখ্যান এরকম:






1967

অথচ বিশ্ব মিডিয়াতে ইসরায়েলীদের হত্যাযজ্ঞকে বলা হচ্ছে যুদ্ধ, আর ফিলিস্তিনীদের প্রতিরক্ষাকে বলা হচ্ছে সন্ত্রাস। অবশ্য এত হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমরা বুঝতে পেরেছি আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া ফিলিস্তিনের মুক্তি সম্ভব না এবং সেই সহায়তার প্রেক্ষাপট নিশ্চয়ই তৈরী হবে। অকুপেশন ১০১ এর মত প্রামাণ্য চিত্র মার্কিনীদের চোখ খুলতে সাহায্য করবে। ইন্টারন্যাশনাল সলিডারিটি মুভমেন্ট আরও প্রসার পাবে। এগুলোই আমাদের স্বপ্ন। কারণ পৃথিবীটা এত ছোট হয়ে গেছে যে প্রতিটি কোণে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লংঘন আমাদের স্পর্শ করে। চোখের সামনে এগুলো ঘটতে দেয়া মানুষ হিসেবে আমাদের অপরাধ। জানি, আমার কিছুই করার নেই। তাই কলম হাতে নেমেছি। কলমই তো মানুষের আবিষ্কৃত সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র। আমরা যদি চাই পৃথিবীতে কলম ছাড়া আর কোন অস্ত্র থাকবে না, তাহলে আন্তর্জাতিক আলোচনার মাধ্যমেই ইসরায়েলের মত সমস্যার সমাধান করতে হবে। সামরিকায়নের যুগ শেষ হোক এটাই তো চাই।

মানুষ হিসেবে অন্য সব মানুষকেই সমান চোখে দেখি। সাধারণ ইহুদীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণেরও তাই প্রশ্ন ওঠে না। আর অকুপেশন ১০১ এ যত বিশেষজ্ঞ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তার শতকরা নব্বই ভাগই ইহুদী। তারা সবাইকে এগিয়ে আসতে বলছেন। কারণ বুদ্ধিজীবীরা যাই বলুন সরকার না চাইলে অর্থাৎ রাজনীতির গণিতে পরিবর্তন না আনতে পারলে কোনই লাভ নেই। এই লেখা পড়ে উৎসাহিত হওয়া কোন একজন মানুষও যদি এ ব্যাপারে কিছু করার ক্ষমতা রাখেন তবেই তো অনেক। যদিও জানি সে সম্ভাবনাও অনেক কম। আবার আমাদের হাতে সময়ও খুব কম। ফিলিস্তিনী মনোবিজ্ঞানী ডঃ ইয়াদ সিরাজ (Iyad Sarraj) বলছেন, ফিলিস্তনের অর্ধেকেরও বেশি শিশুর বেঁচে থাকার ইচ্ছা নেই, বড় হওয়ার ইচ্ছা নেই। কারণ তারা তাদের বাবা-মাকে সবসময়ই ইসরায়েলী সৈন্যদের হাতে অপমানিত হতে দেখে। তাদের সামনেই তাদের বাবাকে মারা হয়। অকুপেশন ১০১ এ এমন একটি মেয়েকে দেখলাম- বয়স ৫-৬ এর বেশি হবে না, সে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।

অথচ আজ থেকে ১০০ বছর আগে জেরুজালেমের অবস্থা এমন ছিল না। তখনও জেরুজালেমে মুসলিম-খ্রিস্টান-ইহুদীরা ছিল। তারা একে অন্যের ছেলেমেয়েদের বেবি সিটার হিসেবেও কাজ করতো। আর আজকে একটি গোষ্ঠীর গগনচুম্বী অপস্বপ্নে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আরেকটি গোষ্ঠী। ইহুদীরা বন্দুকের নিশানা দিয়েই কেবল ফিলিস্তিনীদের দেখছে। ইসরায়েলীরা একজন সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে দেখতে শিখুক, আবার…



[ছবি : ফিলিস্তিনি শিশু]

***** ***** *****

তথ্যসূত্র: ”ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রাম: ইহুদী ষড়যন্ত্র ও আরবদের ভূমিকা” – মুহাম্মাদ হাসনাইন হাইকল

আগ্রহীদের জন্য “অকুপেশন ১০১” প্রামাণ্য চিত্রটি ডাউনলোডের টরেন্ট লিংক

লেখাটি এখান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

সংযোজিত ভিডিও লিঙ্ক -- Peace, Propaganda and the Promised Land: Media & the Israel-Palestine Conflict

আমি এক স্বপ্ন দেখি :: মার্টিন লুথার কিং এর ঐতিহাসিক ভাষণ

ইতিহাসে ব্যক্তিই সব নয়, কিন্তু যদি বলা হয় জর্জ ওয়াশিংটন আমেরিকাকে স্বাধীন করেছেন, আব্রাহাম লিংকন এনেছেন গণতন্ত্র, তবে মার্কিন দেশকে সভ্য করেছেন মার্টিন লুথার কিং। তাঁর নেতৃত্বে কালো মানুষ পেয়েছে সাদা মানুষের সমান অধিকার, আর সাদা নাগরিকেরা পেয়েছে বর্ণবাদের অভিশপ্ত অহংকার থেকে মুক্তি।

তিনি ছাড়া আমেরিকার বড় অংশ সাবেক বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার দশায় পড়ে থাকত। যে দেশে একসময় কালো শিশুরা সাদা শিশুদের সঙ্গে পড়তে পারত না, যেখানে সাদা যাত্রীকে দেখে বাসের আসন ছেড়ে দিতে হতো কোনো কালো মহিলাকে, কোনো শ্বেতাঙ্গিনীকে ভালোবাসার অপরাধে যে দেশে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে কেটে কুটিকুটি করা হতো, মার্টিন লুথারের নাগরিক স্বাধীনতা আন্দোলনের জের ধরে আজ সেই দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন একজন আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ বারাক ওবামা। মার্টিন লুথারের মাধ্যমেই আমেরিকার বর্ণবাদবিরোধী ২০০ বছরের লড়াই পরিণতি পায়। কিন্তু সংগ্রামের শীর্ষ মুহূর্তেই আততায়ীর গুলি কেড়ে নেয় এই মহাপুরুষের জীবন। ১৯৬৮ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে শ্বেতাঙ্গ ঘাতকের গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়।


তাঁর জন্ম ১৯২৯ সালের ১৫ জানুয়ারি। ছিলেন পাদ্রি কিন্তু হয়েছেন অহিংস মুক্তি আন্দোলনের দিশারি। আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধের তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। ছিলেন দারিদ্র্যমুক্তি আন্দোলনের নেতা। আজ বিশ্বে তাঁর স্থান মানবাধিকারের কিংবদন্তি হিসেবে। সবচেয়ে কম বয়সে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্মান তাঁরই। অমর তাঁর মহান সংগ্রাম। একইভাবে অমর তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতা ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’।

১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটনে লাখ লাখ মানুষের মিছিলের শেষে দেওয়া এই বক্তৃতা কখনো ভুলার নয়। এখানে তাঁর সেই বক্তৃতার সংক্ষেপিত অংশ অনুবাদ করে দেওয়া হলো:

এই দিনে আমি আপনাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে খুশি। ইতিহাস এই দিনটি মনে রাখবে, আমাদের জাতির ইতিহাসে মুক্তির মহান সমাবেশ হিসেবে।

যে মহান আমেরিকানের প্রতীকী ছায়াতলে আজ এখানে আমরা দাঁড়িয়ে, শতবর্ষ আগের এই দিনে তিনি মুক্তির সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন। অবিচারের আগুনে ঝলসে যাওয়া নিযুত নিযুত নিগ্রো দাসের সামনে সেই যুগান্তকারী ঘোষণা আশার মশাল হয়ে জ্বলে ছিল। বন্দিত্বের দীর্ঘ রাতের পর সেটা ছিল এক আনন্দময় সকাল।

কিন্তু ১০০ বছর পর মর্মান্তিক সত্য হচ্ছে, নিগ্রো আজও মুক্ত নয়। শতবর্ষ পরও নিগ্রোরা আজও দুঃখজনকভাবে বিচ্ছিন্নতার শেকলে আর বৈষম্যের জিঞ্জিরে বাঁধা। শতবর্ষ পরও নিগ্রোদের জীবন যেন ধন-সম্পদের বিরাট সমুদ্রের মাঝখানে এক নিঃসঙ্গ দারিদ্র্যের দ্বীপ। শতবর্ষ পরও নিগ্রোরা মার্কিন সমাজের এক কোণে নির্জীব দশায় পড়ে আছে, হয়ে আছে নিজভূমে নির্বাসিত। তাই আজ আমরা এখানে আমাদের দুর্দশাকে তুলে ধরতে এসেছি।

এক অর্থে আমরা আমাদের রাজধানীতে এসেছি একটা চেক ভাঙাতে। আমাদের প্রজাতন্ত্রের স্থপতিরা যখন সংবিধানের সেই দারুণ কথাগুলো লিখছিলেন এবং দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা, তখন তাঁরা এমন এক চেকে সই করছিলেন, প্রতিটি আমেরিকান যার উত্তরাধিকারী। সেটা ছিল সব মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অধিকার, মুক্তি ও সুখসন্ধানের নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি।
আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে, আমেরিকা সেই প্রতিশ্রুতিপত্র খেলাপ করেছে, অন্তত তার কালো নাগরিকদের বেলায়। সেই পবিত্র দায়িত্ব মান্য করার বদলে আমেরিকা নিগ্রো মানুষদের হাতে যে চেক ধরিয়ে দিয়েছে, তা ফেরত এসেছে, ‘তহবিল ঘাটতি’র চিহ্ন নিয়ে। কিন্তু ন্যায়বিচারের ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে—এ আমরা বিশ্বাস করতে রাজি না।

আমরা মানতে রাজি না, এই জাতির সুযোগ ও সম্ভাবনার সিন্দুকে যথেষ্ট তহবিল নেই। তাই যে চেক চাইবা মাত্র মুক্তির দৌলত আর ন্যায়বিচারের নিরাপত্তা দেবে, আজ আমরা এসেছি সেই চেক ভাঙাতে।... এখনই সময় ঈশ্বরের সব সন্তানের জন্য সুযোগের সব দ্বার অবারিত করে দেওয়ার। এখনই সময় বর্ণবৈষম্যের চোরাবালি থেকে আমাদের জাতিকে ভ্রাতৃত্ববন্ধনের পাথুরে জমিতে তুলে ধরার।

...যত দিন না নিগ্রোরা তাদের নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারবে, তত দিন আমেরিকায় বিরাম ও শান্তি থাকবে না। যত দিন না ন্যায়ের সুদীপ্ত দিন আসছে, তত দিন বিদ্রোহের ঘূর্ণিঝড় আমেরিকার ভিতকে কাঁপিয়ে দিতে থাকবে।...
...
বন্ধুরা, আজ আমি আপনাদের বলছি, বর্তমানের প্রতিকূলতা ও বাধা সত্ত্বেও আমি আজও স্বপ্ন দেখি। আমার এই স্বপ্নের শেকড় পোঁতা আমেরিকান স্বপ্নের গভীরে।
...
আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন এই জাতি জাগবে এবং বাঁচিয়ে রাখবে এই বিশ্বাস: ‘আমরা এই সত্যকে স্বতঃসিদ্ধভাবে গ্রহণ করছি: সব মানুষ সমান।’

আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন জর্জিয়ার লাল পাহাড়ে সাবেক দাস আর সাবেক দাসমালিকের সন্তানেরা ভ্রাতৃত্বের এক টেবিলে বসতে সক্ষম হবে।

আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন মরুময় মিসিসিপি রাজ্য, অবিচার আর নিপীড়নের উত্তাপে দম বন্ধ করা মিসিসিপি হয়ে উঠবে মুক্তি আর সুবিচারের মরূদ্যান।

আমি স্বপ্ন দেখি, আমার চার সন্তান একদিন এমন এক জাতির মধ্যে বাস করবে, যেখানে তাদের চামড়ার রং দিয়ে নয়, তাদের চরিত্রের গুণ দিয়ে তারা মূল্যায়িত হবে।

আমি আজ এই স্বপ্ন দেখি।

আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন আলাবামা রাজ্যে, যেখানকার গভর্নরের ঠোঁট থেকে কেবলই বাধানিষেধ আর গঞ্জনার বাণী ঝরে, একদিন সেখানকার পরিস্থিতি এমনভাবে বদলে যাবে যে কালো বালক আর বালিকারা সাদা বালক আর বালিকাদের সঙ্গে ভাইবোনের মতো হাত ধরাধরি করবে।
আমি আজ এই স্বপ্ন দেখি।

আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন সব উপত্যকা উত্তীর্ণ হবে, সব পাহাড় আর পর্বত হবে আনত, এবড়ো-খেবড়ো জমিন মসৃণ হবে, আঁকাবাঁকা জায়গাগুলো সমান হবে এবং ঈশ্বরের জয় উদ্ভাসিত হবে এবং একসঙ্গে সব মানব তা চাক্ষুষ করবে।

এই-ই আমাদের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন নিয়েই আমি দক্ষিণে ফিরে যাব। এই বিশ্বাস নিয়ে হতাশার পর্বত থেকে আমরা সৃষ্টি করব আশার প্রস্তর। এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা আজকের এই বেসুরো কোলাহল থেকে জন্ম দেব ভ্রাতৃবন্ধনের সুন্দরতম সংগীতের। এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করব, প্রার্থনায় মিলব একত্রে, একদিন আমরা মুক্ত হব এই জেনে, একসঙ্গে শামিল হব সংগ্রামে।
সেটা হবে সেই দিন, যে দিন ঈশ্বরের সন্তানেরা গাইতে পারবে গান, ভাষায় দেবে নতুন অর্থ: ‘ও আমার দেশ, তুমি তো মুক্তির স্নিগ্ধ ভূমি। যে মাটিতে আমার পিতারা শায়িত, যে মাটি তীর্থযাত্রীদের গরিমা, তার প্রতিটি পাহাড়ের ঢাল থেকে বেজে উঠুক মুক্তির গান।’

এবং আমেরিকাকে মহান এক দেশ হতে হলে এটাই সত্য হতে হবে। তাই মুক্তি ধ্বনিত হোক নিউ হ্যাম্পশায়ারের বিপুল পাহাড়চূড়া থেকে। মুক্তি ধ্বনিত হোক নিউইয়র্কের শক্তিমান পাহাড়গুলো থেকে। মুক্তি ধ্বনিত হোক পেনসিলভানিয়ার ওই আকাশছোঁয়া আলেঘেনির শীর্ষ থেকে।

মুক্তি ধ্বনিত হোক কলোরাডোর তুষারমোড়া পাহাড় থেকে।
মুক্তি ধ্বনিত হোক ক্যালিফোর্নিয়ার বঙ্কিম চূড়া থেকে!
শুধু তা-ই নয়, মুক্তি ধ্বনিত হোক জর্জিয়ার স্টোন মাউন্টেইন থেকেও!
মুক্তি ধ্বনিত হোক টেনেসির লুকআউট পাহাড় থেকে!
মুক্তি ধ্বনিত হোক মিসিসিপির প্রতিটি টিলা ও পাহাড় থেকে। প্রতিটি পাহাড়ের খাঁজ থেকে বেজে উঠুক মুক্তির গান।

যখন আমরা মুক্তিকে ধ্বনিত হতে দেব; যখন প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি বসতি, প্রতিটি রাজ্য এবং শহরে বাজবে মুক্তির গান; তখন আমরা সেই দিনকে আরও কাছে নিয়ে আসতে পারব, যেদিন কালো মানুষ ও সাদা মানুষ, ইহুদি ও জেন্টাইল, প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক—সবাই হাতে হাত ধরে গাইবে সেই নিগ্রো মরমিসংগীত ‘এত দিনে আমরা মুক্ত হলাম! এত দিনে পেলাম মুক্তি! ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, তোমাকে ধন্যবাদ, আমরা আজ মুক্ত!’


ধন্যবাদান্তেঃ
ভাষান্তরঃ ফারুক ওয়াসিফ
সংগৃহীতঃ প্রথম আলো, তারিখ: ২৬-০৫-২০১০

তোমরা কি জানো স্বপ্নের শুরুটা কোথায় :: চেতন ভাগত

আমার যমজ ছেলে দুটোর লাখো ইচ্ছা, কোটি কোটি স্বপ্ন। ছোট একটা খেলনা স্পাইডারম্যানও তাদের বিছানায় লাফ-ঝাঁপ করাতে পারে। পার্কের দোলনার ক্যাচকেচে শব্দও তাদের শিহরিত করতে পারে। বাবার মুখ থেকে শোনা নিছক একটা গল্পও পারে তাদের অনুপ্রাণিত করতে। জন্মদিনের কেক কাটার জন্য কয়েক মাস আগে থেকেই তারা কাউন্টডাউন শুরু করে। তোমরা কি জানো, স্বপ্নের শুরুটা কোথায়? জানো কি, ইচ্ছাশক্তিরা কোথা থেকে আসে? আমি মনে করি, স্বপ্ন আর ইচ্ছাশক্তির জন্ম আমাদের জন্মের সঙ্গেই হয়।

সবার জীবনের একই স্বপ্ন, সফল হওয়া। আর সফলতা হলো প্রদীপের শিখার মতো। প্রদীপ জ্বালাতে তুমি কী করো? প্রথমত, প্রদীপে তেল দাও, যেন জ্বলার জন্য যথেষ্ট জ্বালানি সে পায়। পাশাপাশি কিছু একটা দিয়ে প্রদীপটা আড়ালে রাখো, যেন তা ঝড়-বাতাসের আঘাতে দপ করে নিভে না যায়। সফল হওয়ার স্বপ্নটাও ঠিক সে রকমই। প্রথমত চাই প্রবল ইচ্ছাশক্তি, যার ওপর ভর করে তুমি সফলতার দিকে এগোবে। দ্বিতীয়ত, স্বপ্নটাকে আগলে রাখা চাই। স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে রাখতে হয়, যেন তা কোনোভাবেই ভেঙে না যায়


বেশির ভাগই আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা তাই আমাদের কাছে বিরাট একটা অর্জন মনে হয়, আসলেও তাই। প্রতিদিনের চাওয়াগুলো যেখানে শুধু অর্থের কারণে ভেস্তে যায়, সেখানে অর্থনৈতিক মুক্তিই সবচেয়ে বড় সাফল্য। তবু এটাই জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। তাই যদি হতো, মিস্টার আমবানি (মুকেশ আমবানি, ২০০৬ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির তালিকায় ৫৬তম) আর কোনো কাজ করতেন না। শাহরুখ খান আর নাচ-গান না করে বাড়িতেই বসে থাকতেন। পিক্সার (Pixar) বিক্রি করেই যেখানে কোটি কোটি টাকা কুড়িয়েছেন, উন্নত আইফোনের জন্য স্টিভ জব নিশ্চয়ই আর কঠোর পরিশ্রম করতেন না। তাঁরা এসব এখনো করছেন কেন? কী এমন জিনিস, যা তাঁদের টেনে আনে প্রতিদিনের কাজে, ভেবে দেখেছ কি? তাঁরা এটা করেন কারণ, এতে তাঁরা সুখ খুঁজে পান, আনন্দ পান। তাঁরা এটা করেন কারণ, কাজের মধ্যেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখেন তাঁরা। কাজের মধ্যেই তাঁরা জীবনকে উপভোগ করেন।

তুমি যদি পরিশ্রমী হও, বেশি বেশি পড়াশোনা করো, তুমিও তোমার ফলাফলের মান বাড়াতে পারবে। যদি মানুষের সঙ্গে মিথোস্ক্রিয়া বা স্বতঃস্ফূর্ত মিতালি গড়ে তোলার চেষ্টা করো, দেখবে তুমি যেকোনো সাক্ষাৎকারে ভালো করছ। বেশি বেশি অনুশীলন করলে ক্রিকেটেও তুমি ভালো করতে পারো। এটা হয়তো ঠিক যে তুমি কখনোই টেন্ডুলকার হতে পারবে না। কিন্তু আগের চেয়ে আরেক ধাপ এগোতে তো পারবে। হ্যাঁ, সফল হওয়ার জন্য পরিশ্রম, অনুশীলন আর সংগ্রামের মাধ্যমে এক ধাপ করে এগোনোটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ

নিশ্চয়ই কারও মুখে শুনে থাকবে, জীবন একটা কঠিন ও লম্বা দৌড়। আর আমি যেভাবে দেখেছি, জীবনটা হলো সেই দৌড়ের মতো, যেটা আমরা নার্সারি স্কুলে দৌড়েছি। মুখের মধ্যে একটা চামচ, চামচের ওপর একটা মার্বেল নিয়ে দিতে হবে দৌড়। মার্বেল ফেলে খালি চামচ নিয়ে সবার আগে দৌড়ের শেষ দড়িটা ছোঁয়ার কি কোনো মানে আছে? জীবনটাও ঠিক তাই। যেখানে নিজের স্বাস্থ্য আর মানুষের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক হলো মার্বেল। তোমার পরিশ্রম তখনই সার্থক হবে, যখন জীবনে ছন্দ আসবে। নইলে তুমি হয়তো সফল হবে, কিন্তু এই যে স্বপ্ন সজিব থাকার, আলোকিত হওয়ার, ধীরে ধীরে সেই স্বপ্ন শুকিয়ে মারা যাবে।

জীবনকে কখনোই সিরিয়াসভাবে দেখবে না। যোগব্যায়ামের ক্লাসে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের হাসানোর জন্য নানা গল্প করতেন। একদিন এক ছাত্র জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা স্যার, যোগব্যায়ামের ক্লাস থেকে হাসাহাসির গল্প বাদ দিলে কী হবে?’ স্যার বললেন, ‘সিরিয়াস নয়, সিনসিয়ার হও।’ স্যারের সেদিনের এই কথাটা আমার প্রেরণা জুগিয়েছে—কি লেখায়, কি কাজে কিংবা সবার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে। দেখ, লেখালেখিতে প্রতিদিনই আমার নতুন নতুন ছক-মতের সৃষ্টি হয়। প্রতিদিন প্রশংসা পাই আবার শুনতে হয় কঠোর সমালোচনাও। আমি যদি সবকিছুকেই গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিই, তাহলে কীভাবে আমি লিখব? কিংবা আমি বাঁচব কীভাবে? জীবনটাকে খুব কঠিনভাবে নেওয়ার কিছু নেই। এই তিনটা জিনিস মনে রেখ—লক্ষ্যটা হতে হবে যৌক্তিক, স্বপ্নের সঙ্গে কাজের থাকবে ভারসাম্য আর কাজ করবে আনন্দের সঙ্গে। হ্যাঁ, কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রাণে থাকা চাই আনন্দ। কটা ক্লাস ফাঁকি দেবে, ইন্টারভিউতে তালগোল পাকিয়ে ফেলবে, প্রেমে পড়বে—এসব হতেই পারে। আমরা তো আর মেশিন নই।

প্রথমত, স্বপ্ন ভাঙে যে ঝড়ে, তার নাম ব্যর্থতা। যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুসারে না হয়, তখন তুমি নিজেকে ব্যর্থ মনে করো। পরিশ্রমের তুলনায় ফল না পেলে তুমি বিচলিত হয়ে যাও। ঠিক আছে। কিন্তু বড় হতে হলে নিজেকে আরও শক্ত করতে হবে। ব্যর্থতা এড়ানো খুবই কঠিন। তবে ‘ব্যর্থতা আমাকে কী শেখাল’ নিজেকে এই প্রশ্ন করতে হবে। নিজের ভুলগুলো শুধরে নিতে হবে। হয়তো নিজেকে তুমি দুর্বল ভাবো। হীনম্মন্যতায় ভোগো। সবকিছুর আশা ছেড়ে পালিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করবে তোমার। যেমনটা আমার হয়েছিল, যখন নয় জন প্রকাশক আমার প্রথম বইটা প্রকাশ করার ব্যাপারে ‘না’ বলেছিলেন। জীবনটা আসলে তা-ই, প্রতিযোগিতায় ভরা। হীনম্মন্যতায় না ভুগে বারবার চেষ্টা-সাধনায় যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে হবে।

হতাশা হলো ব্যর্থতার মামাতো ভাই। তুমি কি কখনো হতাশ হয়েছ? তা আবার বলতে, কী বলো? যানজট থেকে শুরু করে কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে হতাশা ঘিরে ধরে আমাদের। হতাশা তোমার উত্তেজনার স্ফুলিঙ্গকে স্তিমিত করে দেয়। এবং সহসা নেতিবাচক ভাবনার সাগরে ডুবিয়ে অকাল মৃত্যু ডেকে আনে তোমার ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছাটার। হতাশা তোমাকে তিলে তিলে তিক্ত করে দেয়। এ জন্য বড় হতে চাইলে হতাশাকে অবজ্ঞা-উপেক্ষা করতে শিখতে হবে।

আজকাল তো সবকিছু লাইন-ঘাটের ব্যাপার। যার বাবা ধনী, যার মুখ সুন্দর, তারা বলিউড থেকে শুরু করে যেকোনো জায়গায় সহজেই সুযোগ পাচ্ছে। গোটা দেশটা যেন বৈষম্যে ছেয়ে গেছে। তবু যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত। একই সঙ্গে যা নেই, তাকে গ্রহণ করার মানসিকতাও থাকতে হবে। দেখ, আমি কিন্তু ঐশ্বরিয়া রাইকে অপছন্দ করি না। কিন্তু আমার দুটো ছেলে আছে, আমি মনে করি তারা ঐশ্বরিয়ার চেয়ে অনেক সুন্দর। হাল ছেড়ো না। কখনোই বৈষম্য-বিচিন্তায় নিজের স্বপ্নকে ছোট করে দেখবে না।

তুমি যতই বড় হবে, নিজেকে আলাদা করে আবিষ্কার করবে। তুমি যখন ছোট ছিলে, আর সব বাচ্চার মতো তুমিও কিন্তু আইসক্রিম খেতে ভালোবাসতে। এখন তুমি কলেজে পড়ছ। কলেজে তোমার মতো আরও অনেক ছাত্র আছে। কিন্তু ১০ বছর পরে নিজেকে সম্পূর্ণ একা দেখবে। তুমি যা চাও, যা তুমি বিশ্বাস করো, যেভাবে ভাবতে ভালোবাস, হয়তো কিছুই তার মিলবে না একেবারে পাশের মানুষটির সঙ্গে। কারও সঙ্গে তোমার স্বপ্নের মিল না দেখে তোমার মনের ভেতর এক ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। কিন্তু কখনোই স্বপ্নের সঙ্গে আপস করবে না। নিজেকেও ভালোবাসতে জানতে হয়। আগে নিজেকে ভালোবাস, তার পরে ভালোবাস অন্যকে।

তোমরা এখন জীবনের সবচেয়ে আনন্দের বয়সে আছ। কেউ যদি আমাকে অতীতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিত, নিশ্চয়ই আমি বেছে নিতাম কলেজজীবনকে। এই সময়ে সবার চোখ-মুখে থাকে জ্যোতি। শোনো, বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। তোমার জীবনেও স্বপ্নপূরণের পথে এ রকম বাধাবিপত্তি একের পর এক আসতেই পারে। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য যেমন ছাতা কিংবা বৃষ্টির পোশাক ব্যবহার করো, ঠিক তেমনি স্বপ্নকেও তোমার সেভাবেই আগলে রাখতে হবে। তুমি, আমি সব মানুষই স্বপ্ন দেখি। সবার মধ্যেই আছে আলোর দ্যুতি। এ জন্যই আমি বলে থাকি, আমি এসেছি লাখো-কোটি নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত দেশ থেকে।

চেতন ভাগত

চেতন ভগত সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক। টাইম সাময়িকী বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ মানুষের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে ঠাঁই করে নিয়েছেন ৩৬ বছর বয়সী এই লেখক।

জন্ম ভারতের নয়াদিল্লিতে, ১৯৭৪ সালের ২২ এপ্রিল। তাঁর সম্পর্কে বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ এ আর রহমান বলেছেন, ‘অনেক লেখকই আছেন, যাঁরা তাঁদের হূদয়কে প্রকাশ করতে পেরেছেন লেখায়, অনেক লেখক নির্দিষ্ট ধাঁচে আপন ধ্যান-ধারণাকে প্রকাশ করতে পেরেছেন। চেতন ভগত হলেন এমনই এক লেখক, যাঁর বই একসঙ্গে দুটো কাজই করেছে, এমনকি তার চেয়ে বেশি কিছু করেছে।’ বই লেখার পাশাপাশি তরুণসমাজকে জাগিয়ে তোলার জন্য উৎসাহমূলক বক্তৃতাও করছেন চেতন ভগত। চেতন ভগত ২০০৮ সালের ২৪ জুলাই পুনের সিমবায়োসিস ইনস্টিটিউট অব বিজনেস ম্যানেজমেন্টের এমবিএ শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে যে বক্তৃতা দেন, তারই ভাষান্তর এই লেখাটি।


কৃতজ্ঞতা: লেখাটি সংগৃহীত হয়েছে প্রথম আলোর ২৩ জুন ২০১০ এর স্বপ্ননিয়ে ফিচার পাতা থেকে

স্বপ্ন কখনো হারায় না :: ল্যারি পেইজ

ইন্টারনেট জগতে সার্চ ইঞ্জিন গুগলের উদ্ভাবক ল্যারি পেইজ একজন আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং ইন্টারনেট উদ্যোক্তা।১৯৯৮ সালে ল্যারি ও তাঁর বন্ধু সার্গেই ব্রিন মিলে গুগলের যাত্রা শুরু করেন। তিনি ২০০৯ সালের ২ মে ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এই বক্তৃতাটি দেন।


* * *
অনেক দিন আগের কথা। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাস। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে বিভিন্ন কাজ থাকত। তারই একটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের রান্নাঘরের দেয়াল ও ছাদ থেকে ময়লা পরিষ্কার করা। আর ওই ময়লা পরিষ্কার করতে গিয়ে মা ও বাবার পরিচয়। সুতরাং আমার আসা সেখান থেকেই। আমার বাবা এই মিশিগানেই কম্পিউটার যোগাযোগ বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। কিন্তু এটা তিনি করেছেন ৪৪ বছর আগে। বাবা ও মা নিজেদের পোশাকগুলো নিজেরাই তৈরি করেছেন। আমার বাবার পোশাক আমি পরেছি, আমার পোশাক আমার ছোট ভাই পরেছে। আরও কত কী!

আমি এগুলো বলছি কারণ, এটাই হচ্ছে আমার এত দূর আসার পথ। আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না যে এখানে আসতে পেরে আমি কতটা গর্বিত।
স্বপ্নপূরণের জন্য আমার একটি গল্প আছে। অথবা সত্যিকারের স্বপ্ন খুঁজে পাওয়ার জন্যই আমার গল্পটি আমাকে সহায়তা করে।

তুমি কি জানো, মধ্যরাতে রঙিন স্বপ্ন দেখে কীভাবে জেগে উঠতে হয়? এবং তুমি কি জানো, তোমার বেডের পাশে কাগজ আর কলম না থাকলে ওই স্বপ্ন তুমি কীভাবে মনে রাখবে?

আমার যখন ২৩ বছর বয়স, তখন এ রকম স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম। হঠাৎ করে যখন আমি জেগে উঠলাম, ‘তখন চিন্তা করছিলাম, আমরা কি পুরো একটি ওয়েব পেজ ডাউনলোড করতে পারি শুধু এর লিংকটা দিয়ে?’

তখনই আমি একটি কলম ও খাতা নিয়ে লেখা শুরু করে দিলাম। মাঝেমধ্যে এভাবে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে জেগে উঠতে হয়। আমি মধ্যরাত পর্যন্ত সময় ব্যয় করেছি চিন্তাভাবনা করতে। আমি আমার উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি ব্যাপারটি নিয়ে। তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তুমি চালিয়ে যাও, তুমি পারবে।’ কখনো চিন্তা ছিল না আমরা একটি ‘সার্চ ইঞ্জিন’ তৈরি করতে পারব। কিন্তু আমাদের চেষ্টা দিয়ে সফল হলাম। এভাবেই গুগলের জন্ম।

যখন আমি মিশিগানে ছিলাম, তখন চিন্তা করতাম, কীভাবে স্বপ্নকে বাস্তবে আনা যায়। আমি বিভিন্ন কর্মশালায় গিয়ে নিজেকেই নিজে অনুপ্রাণিত করেছি। আমি মনে করি, স্বপ্ন কখনো হারায় না। সাময়িকভাবে লুকিয়ে থাকে মাত্র। যদি আমরা কঠোর পরিশ্রম করতে পারি, আর সেই পরিশ্রম যদি কোনো লক্ষ্য ঠিক রেখে করা যায়, তবে সমাধান আসবেই আসবে।

আমি মনে করি, উচ্চাশা সফল করা সম্ভব। সফল করতে অনেক বেশি উত্তেজিত হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু তোমাকে তোমার সঙ্গে মৃদু প্রতিযোগিতা করতে হবে প্রতিনিয়ত। সর্বোচ্চ ভালো মানুষেরা বড় বড় চ্যালেঞ্জের সঙ্গে কাজ করতে চান। যেমনটি গুগলে হয়েছিল। আমাদের উদ্দেশ্য, পৃথিবীর সব তথ্য একত্র ও বিশ্বজনীন করা এবং সহজে যাতে ব্যবহার করা যায়। আমি ও আমার সহযাত্রীরা যখন গুগলে কাজ শুরু করলাম, তখন ভীষণ চিন্তায় ছিলাম, আমার পিএইচডি থমকে না যায়! কিন্তু আমি পিএইচডি সম্পন্ন করেছি। সুতরাং তোমাকে তোমার মূল রাস্তায় থাকতে হবে, তারপর তোমার কাজ। এটা অনেকটা বৃষ্টির সময়ের মতো। মানে, বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটার সময় তোমাকে ছাতার চেয়ে নিচের দিকে খেয়াল বেশি রাখতে হবে; না হলে গর্তে পড়ে তোমার শরীর নোংরা পানিতে ভিজে যাবে।

প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে সবাই অনেকটা অলস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনই উপযুক্ত সময় তোমার আলোড়িত হওয়ার। তুমি কি পারো তা দেখিয়ে দিতে। সুতরাং স্বপ্নে বসবাস করার ইচ্ছে বাদ দিলে চলবে না। কারণ তোমাকে পৃথিবীর দরকার।

কোনো এক সকালে তুমি অনেক আত্মবিশ্বাসী হবে। কিন্তু সৃষ্টির নেশা যদি থাকে, তবে তাকে ভুলে যাওয়া যাবে না। তুমি তোমাকে অন্যের থেকে আলাদা ভাববে এবং মনে করবে, তুমি যে সুযোগ পেয়েছ, কেউ তা পায়নি। সুতরাং তোমাকে এটা শেষ করতে হবে। তোমাকে পার্থক্য করতে হবে অন্যের থেকে তোমার কাজের মাধ্যমে। তারপর তোমার জীবনই তোমাকে বয়ে নিয়ে বেড়াবে।

১৯৯৬ সালের মার্চে বাবা মারা গেলেন। বাবা মারা যাওয়ায় আমি অত্যন্ত হতাশার মধ্যে পড়ি। কিন্তু আমি আমার অস্তিত্বকে খুঁজে পাই বাবার মধ্যে। বাবা বলতেন, ‘আমরা পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। তার মধ্যে এক নম্বর হলো অটোমেশন বা স্বনিয়ন্ত্রিত যান্ত্রিক ব্যবস্থা, দুই. কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, যেখানে শিক্ষা থাকবে অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার মধ্যে। আমাদের একটা অংশকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে বিজ্ঞানের উন্নয়নে, মেডিসিনে এবং শিল্প খাতে, না হলে আমাদের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে। এর মাধ্যমেই একটি জাতির ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবে তার আগামী প্রজন্মকে। যদি আমেরিকার সব যুবক শিক্ষার মধ্যে তাদের খুঁজত, তবে আমেরিকা আরও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতো।

গুগলের যাত্রাপথে অনেক বাধার সম্মুখীন আমরা হয়েছি; কিন্তু আমরা তার সমাধান করে সামনে চলে এসেছি। আমি মনে করি, আমি যতটুকু না পেরেছি, তার চেয়ে বেশি পেরেছে আমার বয়সটা। আমার ওই ২৩-২৪ বয়সটাই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। সুতরাং আমি মনে করি, তোমরা স্বপ্ন দেখো অনেক বড় হওয়ার কিংবা বড় কিছু করার। সঙ্গে সেই স্বপ্ন কীভাবে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায় তার চিন্তা তোমাকেই করতে হবে। আর যদি তা করতে পারো, তবেই তুমিই সাফল্যের গায়ে তিলক আঁকতে পারবে। আর আমি যদি পারি, তোমরাও পারবে। এখন হাতের নাগালে প্রযুক্তির ছোঁয়া। সুতরাং চেষ্টা চালিয়ে যাও। আর চেষ্টা চালাও অনেক ভালো স্বপ্ন দেখতে। যে স্বপ্নের মধ্যে থাকবে তোমাকে আলাদা করার ক্ষমতা।

ল্যারি পেইজ

গুগলের স্বপ্নদ্রষ্টা লরেনস ল্যারি পেইজ ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। লরেন্স "ল্যারি" পেইজ (ইংরেজি: Lawrence "Larry" Page) একজন আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং ইন্টারনেট উদ্যোক্তা। তিনি গুগল এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ২০শে জানুয়ারি, ২০১১ সালে তাকে গুগলের প্রধান নির্বাহী ঘোষণা দেওয়া হয় এবং তিনি ৪ঠা এপ্রিল, ২০১১ থেকে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে, তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ আনুমানিক $১৬.৭ বিলিয়ন। ল্যারি পেইজ মিশিগানের ইস্ট ল্যান্সিংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কার্ল পেইজ ১৯৬৫ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার বাবা ও মা উভয়েই মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন।

ধন্যবাদান্তে : ল্যারির বক্তব্য ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ আলী এই অনুবাদটি প্রথম আলোর স্বপ্ন নিয়ে তে (২০১০) প্রকাশিত হয়েছিল।

স্বপ্নপূরণের পথে :: এ পি জে আবদুল কালাম

তার পুরো নাম: আবুল পাকির জয়নুল আবেদীন আবদুল কালাম। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বিজ্ঞানী। ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর ভারতের তামিলনাড়ুতে তাঁর জন্ম। জীবনে বহুবার নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তরুণদের উদ্দেশে প্রেরণাদায়ক ও উত্সাহব্যঞ্জক বক্তৃতা করেছেন এই ‘ভারতরত্ন’। সর্বশেষ ১৯ এপ্রিল, ২০১০ জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণদের উদ্দেশে ‘জীবন, স্বপ্ন ও কাজ’-এর ওপর যে বক্তৃতা করেন এখানে তার নির্বাচিত অংশ।

জীবনের লক্ষ্য: স্বপ্ন আর দৃঢ় সংকল্প

বন্ধুরা, সফল যাঁরা, কেমন তাঁরা—এ প্রশ্ন অনেকেরই। তুমি যদি কোনো সফল ও আদর্শ মানুষের জীবনের ইতিহাস চর্চা করো, দেখবে, শৈশবেই তাঁর মনে একটা স্বপ্ন বাসা বাঁধে। স্বপ্নটাকে সত্যি করার জন্য একটা দৃঢ় সংকল্প থাকে তাঁর। আর প্রতি পদে-পরিস্থিতিতে স্বপ্নটা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয় লক্ষ্য ছোঁয়ার কথা। আর কারও নয়, নিজের সত্যি গল্পটাই তোমাদের শোনাতে পারি।


বয়স তখন সবে ১০। তখনো কিন্তু আমরা বিদ্যুত্ পাইনি। মনে আছে, সন্ধ্যা নামলে কেরোসিনের প্রদীপ জ্বালিয়ে পড়তাম। সেই কেরোসিন ছিল রেশন কার্ড দিয়ে কেনা! আমি তখন পড়ি পঞ্চম শ্রেণীতে। শ্রী শিবাসুব্রাহ্মনিয়া ছিল আমাদের সবার পছন্দের শিক্ষক। একদিন তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে উড়ন্ত একটা পাখির চিত্র আঁকলেন। পাখিরা কীভাবে ওড়ে, উড়তে উড়তে কী করে তারা পথ পাল্টায়, তিনি তা শেখাচ্ছিলেন। ২৫ মিনিটের ক্লাস। এরপর তিনি জানতে চাইলেন, ‘বুঝতে পেরেছ?’ আমি দ্বিধাহীনভাবে বললাম, ‘না’। ক্লাসের অনেক ছাত্রই বলল, ‘বুঝতে পারিনি’। স্যার কিন্তু রাগলেন না। বরং বিকেলে আমাদের নিয়ে গেলেন রামেশ্বরাম সমুদ্রসৈকতে। জলের কলতান আর পাখিদের কিচিরমিচির গান, ওহ! এখনো ভুলতে পারিনি সেই সন্ধ্যার স্মৃতিটা। লেজ বাঁকিয়ে ডানা ঝাপটে পতপত শব্দে কী সুন্দর উড়ছে পাখিরা। কী আশ্চর্য, যেদিকে মন চাই সেদিকেই উড়ছে তারা। ‘বলো তো বন্ধুরা,’ স্যার জানতে চাইলেন, ‘ওড়ার জন্য পাখিদের ইঞ্জিনটা কোথায়?’ কিছুক্ষণ পরে আঁধার নেমে এল, কিন্তু আমরা এরই মধ্যে জেনে গেছি, পাখিরা ওড়ে নিজ জীবন আর ইচ্ছাশক্তির প্রেরণায়।

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলাম উড়ু উড়ু মন নিয়ে। বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে তারাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ঠিক করলাম, বিমান-বিজ্ঞানী হব। পরের দিন স্যারকে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, কীভাবে আমি বিমান-বিজ্ঞান সম্পর্কে আরও জানতে পারব?’ তিনি বললেন, ‘আগে অষ্টম শ্রেণী শেষ করো। তারপর হাই স্কুলে যাবে। এরপর যেতে হবে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। যদি তুমি সব ক্লাসেই ভালো করো, তবেই তোমার স্বপ্ন সত্যি হবে।’ কলেজে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার পর আমি মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করি। নিরন্তর শ্রম সাধনায় হয়ে উঠলাম একজন রকেট ইঞ্জিনিয়ার ও প্রযুক্তিবিদ। সেদিনের দেখা স্বপ্নটা আমার এভাবেই সত্যি হলো।

বন্ধুরা, তোমরা কামারশালায় গেলে দেখবে, কীভাবে আগুনে লোহা গলিয়ে নির্দিষ্ট ছাঁচের হাতুড়ি বানানো হয়। ঠিক একইভাবে তোমার জীবনের লক্ষ্যটাকে নির্দিষ্ট করতে হবে। স্বপ্ন দেখো আর দৃঢ় সংকল্প আঁকো মনের মধ্যে।

চাই জ্ঞান চর্চা

মনের কোণে শুধু স্বপ্ন আঁকলেই তো হবে না। চাই নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞান আহরণ। তা ছাড়া স্বপ্ন কখনোই সত্যি হবে না। জ্ঞান তোমাকে মহান করবে। জ্ঞান তোমাকে সফলতার দ্বারে ঠেলে নিয়ে যাবে। কাজ করার সময় নানা সমস্যা দেখা যাবে। কিন্তু মনে রাখবে, সমস্যা যেন কোনোভাবেই তোমার ওপর গুরুগিরি করতে না পারে। সমস্যাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করবে না। সমস্যার সমাধান করেই এগোতে হবে তোমাকে। দেখবে সাফল্যরা কেমন সূর্যের মতো, তারাদের মতো তোমার চারপাশে ঝিলমিল করবে।

কঠোর পরিশ্রম

লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অবশ্যই কঠিন পরিশ্রমী হতে হবে। অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। সময়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আমার জীবন থেকে বুঝেছি, কেউ যখন কোনো স্বপ্ন পূরণের জন্য সচেষ্ট হয়, তার মনে এক ধরনের জেদ তৈরি হয়। ফলে তার কাজের ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ে। স্বপ্ন আর কাজের মাধ্যমেই তৈরি হয় মেধা। মনে রাখবে, তুমি যতই বিশেষজ্ঞ হও না কেন, তোমাকে অবশ্যই প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকতে হবে। কারণ, অনুশীলনের বিকল্প কিছু নেই। স্বপ্ন যদি পূরণ করতে চাও, তোমার যত শক্তি তার সবটুকু প্রয়োগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

ব্যর্থতা জয় করার সাহস

তুমি যখন কোনো লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করবে, দেখবে সেখানে অনেক ধরনের সমস্যা আসবে। হয়তো সমস্যার সমাধান করতে পারছ না। নিজেকে ব্যর্থ মনে হতে পারে। তোমার মনে হবে, আর বুঝি সম্ভব না। কিন্তু সত্যিকারের সফল যারা, তারা ব্যর্থতাকে ভয় করে না। বরং তারা জানে, ব্যর্থতাকে জয় করেই এগোতে হবে। ব্যর্থ হলে প্রথমেই ধৈর্য ধরতে হবে। মনে রেখো, পরিস্থিতি সামলাতে হবে নিজেকেই। এ জন্য দরকার সাহস।

নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা

পৃথিবীতে কেউ শ্রেষ্ঠ হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। এটা একটা প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিংবা একটা জাতি নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। সফলদের একটা স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্নের পেছনেই তারা ছোটে। আগে থেকেই তারা প্রস্তুত থাকে যেকোনো ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য। ব্যর্থ হলে তারা ভেঙে পড়ে না। বরং নতুন উদ্যমে কাজ করে যায়। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যায়। তারা কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না। কিন্তু তারা নিজেদের সঙ্গেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। গতকাল যতটা কাজ করেছে আজ তার চেয়ে বেশি কাজ করে। আর প্রতিজ্ঞা করে, আজ যা কাজ করেছে তার চেয়ে বেশি কাজ করবে আগামীকাল। তুমিও তা-ই করো। এভাবেই শ্রেষ্ঠত্ব আসে। এভাবেই স্বপ্ন হয় সত্যি।


সংগৃহীত : প্রথম আলো ২০১০
নির্বাচিত অংশ ভাষান্তর: জাহাঙ্গীর আলম