পরিশ্রম করলেই কেবল ভাগ্য সহায় হয় : জেমস ক্যামেরন

জেমস ক্যামেরন, বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রই নির্মাণশৈলী ও ব্যবসা-সফলতার ক্ষেত্রে ইতিহাস গড়েছে। টারমিনেটর-২ (১৯৯১), টাইটানিক (১৯৯৭) কিংবা অ্যাভাটার (২০০৯)-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।ক্যামেরন ১৯৫৪ সালের ১৬ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৯ সালের ১৮ জুন দেওয়া এক সাক্ষাৎকার :


আমার ছোটবেলা কেটেছে কানাডার ছোট্ট একটা শহরে। শহরের তীরঘেঁষে বয়ে গেছে ছোট্ট একটি নদী, যেখানে আমরা রোজ খেলতাম। নায়াগ্রা জলপ্রপাত ছিল মাত্র চার বা পাঁচ মাইল দূরে। পানির সঙ্গে তাই একটা ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল, যা আমার কাজেও বারবার উঠে এসেছে। মা ছিলেন গৃহিণী, খুব ভালো ছবি আঁকতেন। আর বাবা ছিলেন প্রকৌশলী। মায়ের সঙ্গে জাদুঘর দেখতে যেতাম; তাই যখন থেকে আঁকতে শিখেছি, তখন থেকেই জাদুঘরের বিভিন্ন স্মারকের অবয়ব আঁকতে চাইতাম, সেটা হোক না পুরোনো কোনো যোদ্ধার হেলমেট কিংবা মিসরীয় কোনো মমি। এসব কিছু আমাকে আবিষ্ট করে রাখত। আবার প্রকৌশল চর্চাতেও আকর্ষণ ছিল প্রচণ্ড। হতে পারে বাবার সম্মান ও পছন্দকে ধরে রাখার জন্য এটা একটা চেষ্টা ছিল। কিংবা হতে পারে তা প্রযুক্তির প্রতি একটা ভালোবাসা, যা আমি রক্তের টান থেকে অনুভব করেছি।

শিশু বয়সেই আমি সব সময় কিছু একটা নির্মাণ করতে চাইতাম। ‘চলো বানিয়ে ফেলি একখানা ঠেলাগাড়ি, চাকাগুলো নিয়ে আসো, তুমি সেটা ঠিক করো...।’ যখন পেছনের দিকে ফিরে তাকাই, তখন আমি আজকের এই আমিকেই সেখানে খুঁজে পাই। মনে পড়ে সেই ছোট্টকালে একটা উড়োজাহাজ বানাতে উঠেপড়ে লেগেছিলাম, আজও তো তেমনটিই করছি, পার্থক্য এই যে এটি বানাতে এখন ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ পড়ে যায়।

শিক্ষাজীবনে খারাপ নই, ছাত্র হিসেবে ভালোই ছিলাম। কারণ পুরোটাই ছিল জানার প্রতি আমার সহজাত তীব্র আকর্ষণ। আমি কাউকেই খুশি করার জন্য পড়িনি। কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পড়াশোনাও হয়নি যে কাউকে টপকে ভালো করতে হবে। আমি জানতে চাইতাম, শিখতে চাইতাম—বিজ্ঞান, ইতিহাস, গণিত সবকিছু। অবসর সময়ে শহরের পাঠাগারগুলোয় সময় কেটে যেত আমার। অনেক সায়েন্স ফিকশন পড়েছি, যা বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝের রেখাকে ধীরে ধীরে অস্পষ্ট করে তুলেছে। বই আর লেখকদের অভিনব জগৎ আমাকে অদ্ভুতভাবে টানত। আর্থার ক্লার্ক, জন ভগ্ট, হার্লান এলিসন, ল্যারি নিভেন সবাই আমাকে প্রভাবিত করেছেন।

একাদশ গ্রেডের সময় আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জীববিজ্ঞানের শিক্ষক ম্যাকেঞ্জি ঠিক করলেন আমাদের স্কুলে একটা থিয়েটার বানাবেন। স্কুলে রেসলিং, ফুটবল, বাস্কেটবলের আয়োজন থাকলেও থিয়েটার ছিল না। আমরা নেই থেকেই কাজ শুরু করেছি। দৃশ্য, পেছনের পর্দা, পোশাক সব উপকরণের জোগাড় করতে হয়েছে। তারপর নাটক প্রযোজনা করেছি। পুরোটাই ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। এবং আমরা সফল হয়েছি। নিয়ম মেনে ঠিকঠাকভাবেই এগিয়েছিলাম। আমাদের পুরো প্রকল্পটাই ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। সেটা সম্ভব করেছিলেন ম্যাকেঞ্জি। এটাই তাঁর অভিনব একটি বৈশিষ্ট্য। এ জন্যই আমি মনে করি, জীবনের সঠিক সময় এমন কিছু ব্যক্তিত্বের ভূমিকা অনস্বীকার্য, যাঁরা তোমাকে বদলে দেবে, তোমার ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

আমি কখনোই নিজেকে ঈশ্বরের উপহার মনে করি না। নিজেকে অন্য শিশুদের চেয়ে আলাদা করে দেখারও কিছু নেই। নিজেকে সবার থেকে আলাদা বানিয়ে দেয় চারপাশের পরিবেশ এবং তোমার অভিনব ক্ষমতা। আমি জীবনের ১০টি বছর এমনভাবে কাটিয়েছি, যেখানে আমাকে শুনতে হয়েছে আমি ইডিয়ট কিংবা একটা জোক ছাড়া কিচ্ছু নই। তার পরের ২৫ বছর আমার চেষ্টাটা ছিল শুধু নিজেকে একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে তৈরি করা। সফলতা সেখানে সামান্যই এসেছে। সফল হওয়ার জন্যই কি আমার নিয়তিকে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল? ঠিক বলতে পারব না।

তবে আমি মনে করি, যত পরিশ্রম করবে ততই ভাগ্য তোমার সহায় হবে। দীর্ঘ পথের অর্জনে ‘সুযোগ’ বড় কোনো কিছু নয়। কিন্তু একটি মাত্র সুযোগ সবকিছু বদলে দিতে পারে। তবে সেখানেও ওই সুযোগকে চেনার একটা ব্যাপার আছে, সুযোগ কাজে লাগাতে পারার একটি ক্ষমতার প্রয়োজন আছে। অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তিই সফল হতে পারেননি, কারণ তাঁরা অনেক বেশিই ভেবেছেন এবং খুব সতর্ক ছিলেন, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী হয়ে পা ফেলার ব্যাপারে তাঁরা ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। যদি তোমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস না থাকে, তাহলে সুযোগও তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে।

জীবনের অনেকটা সময় ধরেই বুঝতে পারিনি যে ছবি বানাব, ছবির নির্মাতা হব, বিজ্ঞানকে নিয়েই গভীরভাবে মগ্ন ছিলাম। ছোটবেলার অনেকটা সময় পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করে মাইক্রোস্কোপের পর্দায় খুঁজতাম প্রোটোজোয়া। কখনো টেলিস্কোপে চোখ মেলে নক্ষত্ররাজিতে হারিয়ে যেতাম। আমার চিন্তাভাবনার পরিসরটা ছিল বিজ্ঞানের বিচিত্র দিককে ঘিরেই। আঁকার প্রতি টান সব সময়ই ছিল। পদার্থবিজ্ঞান আর গণিত নিয়ে পড়াশোনার পাঠ শেষ হলো। তারপর এক অসহনশীল শিক্ষকের পাল্লায় পড়ে ক্যালকুলাসের সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ ঘটে। আমি ইংরেজি বিষয়ে মনোনিবেশ করি, কারণ আমি লিখতেও চাইতাম খুব। এ দুই দিকে উদ্ভ্রান্ত পথ চলতে চলতে ২৫-২৬ বছরে আমি ঠিক করি, ছবি বানানো নিয়ে অগ্রসর হব। নিজেকে ভেবেছিলাম ছবি বানানোর কারিগর হিসেবে, পরিচালক হিসেবে নয়। তবুও...

যে ছবিগুলোর তেমন কোনো বাঁধাধরা প্যাটার্ন নেই, সেগুলোই এসে আমার পছন্দের তালিকায় হাজির হয়। আমি দেখেছি, নিয়মকানুন আমার জন্য ঠিক কাজ করে না। ভালো লাগে যেখানে অনেক হাঙ্গামা থাকবে, শব্দ থাকবে, অস্থিতিশীলতা থাকবে—পরিপূর্ণ কিছু নয়। সেখানেই তো নিজেকে উপস্থাপনের সুযোগ মেলে। যদি সবকিছু তোমার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত কিংবা টিপটপ হয়ে থাকে, তবে জাদুকরি কোনো কিছু উপহার দেওয়ার জন্য দরজাটা তো খোলা যায় না। পরিচালকের মন থেকে তো আর মোহনীয় জাদুর স্পর্শটা প্রতিফলিত হয় না, এটা আসে অভিনয় কুশলীর আত্মার মধ্য থেকে। আন্দোলিত হয়েছি উডস্টক, দ্য গ্র্যাজুয়েট, বান এন্ড ক্লাইড, দ্য গডফাদার, স্টার ওয়ারস প্রভৃতি ছবি থেকে।

ছবি বানানোর কথা শুনে পরিবার কখনোই তেমন সন্তুষ্ট হয়নি। বাবা নারাজ ছিলেন, তিনি আসলে আমার ব্যর্থ হওয়ায় অপেক্ষায় ছিলেন, যেই মুহূর্তে তিনি জানাবেন যে আমার আসলে একজন প্রকৌশলী হওয়াই উচিত ছিল। তাঁর পক্ষ থেকে সহয়তা ছিল একেবারে শূন্য। মা অবশ্য অনেক আগে থেকে এ ধরনের সৃষ্টিশীল শিল্পের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। তাই আশ্চার্য এক গতি ছিল সেখানে, যা আমাকে দীর্ঘ সময়েও এ পথ চলতে সাহায্য করেছিল, যদিও তা দেখতে পাওয়া ছিল দুষ্কর।

যখন ছবি বানানো শুরু করলাম তখন মনে মনে কী অর্জন করতে চেয়েছি সেটা নিয়ে বলা কঠিন। আমার মনের মধ্যে তখন অসংখ্য ছবি, ফ্রেম, দৃশ্যের আনাগোনা করছিল। অনেক বেশি বিজ্ঞান কল্পকাহিনির রাজত্ব ছিল সেখানে। ভিন্ন পৃথিবী আর ভিন্ন পরিবেশের জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমার জন্য এটা ছিল কল্পনা কিন্তু পুরোদস্তুর কল্পনাই কি ছিল তা? পুরোটা জীবন আমাকে অনেক অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে। অনেক শিখেছি সেখান থেকে। আজও শিখছি। তবে শেখাগুলোকে নিয়েই আরও মহৎ কিছু তৈরি করার বড় শিক্ষাটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া। টাইটানিক ছবিটি আমার সব শেখাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অসংখ্য শিল্পীর কাজ ছিল সেখানে। সবার কাছে এত প্রভাবিত হয়েছি যে মনে হয়, তাঁদের ছাড়া এতটা সম্ভব হতো না।

যখন তুমি কোনো বৃহৎ ক্ষেত্রে কাজ করবে ও অনেককে নিয়ে তোমার কাজ করতে হবে তখন আত্ম সন্দেহের প্রয়োজন নেই। যদি তোমার কাজ খারাপ হয় তবে তুমি তাঁদের কাছ থেকে সেখানকার ভুলগুলো সম্পর্কে সমালোচনা শুনবে, যদি ভালো হয় তবে তুমি ভালোই শুনবে। অনেকেই তোমার সঙ্গে থাকবেন, যাঁরা তোমাকে পথ এগিয়ে নিয়ে যাবে, তাই সন্দেহের কোনো স্থান এখানে নেই। এমন আবহাওয়াতেই আমরা কাজ করি।

ছবি বানানোর যে বিশাল ক্ষেত্র সেখানে কিছু পদ্ধতি কখনোই পরিবর্তিত হয় না। প্রযুক্তি আর নির্মাণকৌশলের সব ধারাটাই বদলাতে থাকে। এগুলোর বদল দিয়েই ছবির ধারা ভিন্নরূপ ধারণ করে। দৃশ্যপট বদলে যায়। সেখানে সংযোজন ও বিয়োজন ছবির চাওয়াকে সবার সামনে তুলে ধরে। জীবনের ছকটা তো সে রকমই।

অ্যাকাডেমি অব অ্যাচিভমেন্ট থেকে পাওয়া। ১৯৯৯ সালের ১৮ জুন দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশের অনুবাদ: শিখিত সানী
সংগ্রহ করা হয়েছে, প্রথম আলো থেকে

No comments:

Post a Comment