কায়সার ও কিসরা - নসীম হিজাযী

​​
​​
আদী ও তার ছেলেরা ওমরকে খুঁজতে বেরিয়েছে এক প্রহর আগে । প্রদীপের ক্ষীণ আলোয় বসে আছে সামিরা । তার ডাগর আঁখিতে বেদনার ছাপ । সামিরা দুহাত উপরে তুলে দরদমাথা কণ্ঠে প্রার্থণা করছিলো : "ওগো মানাত! প্রথিবীর কোন কিছুই তো তোমার কাছে গোপন নেই । ভাইজান কোথায় আছে তা তুমিই জানো..."

..আসেম ভেবেছিলো ওমরকে পৌঁছে দিয়েই ফিরে যাবে সে । শান্তির দিনগুলো শেষ না হলেও আওসের কারো পক্ষে বনু খাজরাজের সীমায় পা রাখা নি:সন্দেহে অবাঞ্চিত ঘটনা...

....ইউসিবার প্রশ্নের জবাবে ইরজকে বিস্তারিত বলতে হলো, "মিসর থেকে সংবাদ পেয়েছি, আসেমের খোজ পাওয়া যাচ্ছেনা..." ইউসিবা চমকে তার দিকে তাকালো.. কিন্তু ইউসিবাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বেড়িয়ে গেলো ইরজ । ....

নীলনদের উপত্যকা বেয়ে দক্ষিণ দিকে চলছিলো ইরানী লশকর......

* * * * * * * * * *

..... কায়সার ও কিসরা হলো আজ হতে পনেরো শতক পূর্বে আরবে দ্বীন ইসলামের আবির্ভাবের সময়কার রোম ও পারস্যের প্রেক্ষাপটের এক অবিষ্মরনীয় ঐতিহাসিক উপন্যাস । কায়সার ও কিসরা যারা পড়েনি, তারা ওই সময়টার পৃথিবীকে চেনে কেবল মক্কা-মদীনা দিয়ে । মুহাম্মাদ সা: এর জন্ম থেকে শুরু করে নবুওয়্যাত - দাওয়াত - নির্যাতনের শিকার হওয়া - হিজরত - যুদ্ধবিজয় - বদর ওহুদ খন্দক - আলী- ওমর - আবুবকর - আব্বাস - হামজা -সালমান ফারসী .. মুসলিম ঘরে ঘরে এই তো গৎবাঁধা পরিচিত ঘটনাপণ্জী । কায়সার ও কিসরা যারা পড়বে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন এঙ্গেল থেকে রুদ্ধশ্বাস আনন্দে জানতে পারবে সেই সময়টাকে ! কসম করে বলছি, এই বইটার প্রথম পাতা থেকে শুরু করে চারশত পনেরো পাতায় পৌছানোর আগে পর্যন্ত কোন পাঠক বই ছেড়ে উঠতে পারবেনা ।

ইয়াসরিব (মদীনা) এর বনু আওস গোত্রের এক যুবক আসেমকে নিয়ে শুরু হয় গল্পটা । এও এক নতুনত্ব । আজ পর্যন্ত সীরাতুন্নবী কিম্বা আরবের ইতিহাসের অন্য কোন গল্প এভাবে শুরু হতে দেখিনি । অস্ত্র কেনার জন্য ঋণ দিয়ে, কখনো রাতের আধারে একগোত্রের বাগানে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে, কখনো গুপ্ত হত্যা করে বনু আওস ও বনু খাজরাজের রক্তাক্ত শত্রুতায় ইন্ধন যুগিয়ে ইয়াসরিবের প্রভাবশালী বিচারক গোষ্ঠীতে পরিনত হয় চিড়দিনের ষড়যন্ত্রকারী ইয়াহুদীরা ।

আরবে কণ্যাশিশুর পিতা হবার অপমানের জ্বালা জুড়াতে জীবন্ত কবর দেয়ার কথা তো এতদিন কেবল বর্ণনা পড়ে এসেছি । কায়সার ও কিসরায় পেলাম তার মর্মস্পর্শী গল্পগাঁথা ।

যারা ভাবছেন, আমরা নবীর জীবনী জানি, আরবের ইতিহাস জানি, নতুন করে সেগুলো পড়তে বিরক্ত লাগবে, তাদের বলছি, এ উপন্যাসে আরবের অংশটা বড় সামান্য । খুব অল্প সময় এটা আরবে থাকে । চলে যায় রোমে - চলে যায় পারস্যে ! সিরিয়া - হেজাজের শহরগুলোতে সরাইখানায় বা যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে - সমুদ্রবন্দরগুলোতে - রাজপথ থেকে রাজপ্রসাদগুলোতে - বস্তিগুলোতে , পাহারে, উপত্যকার সংকীর্ণ রাস্তাগুলোতে- কখনো উষর মরুর উটের চামড়ায় গড়া তাবুগুলোতে। রোম আর পারস্যের যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে চিরদিন পিষ্ট হয় সাধারন অসহায় মানুষগুলি । রোম বা পারস্য কারো বিজয় বা পরাজয়ই তাদের ভাগ্যকে একচুল পরিবর্তন করতে পারেনা

গল্পের পরতে পরতে পাঠকের মনে শান দিয়ে যাবে আইয়্যামে জাহেলিয়ার বিভৎস অন্ধকার । মানবতার ডুকরে ডুকরে কান্নার ফোপানি । সারা দুনিয়া জুড়ে... অসংখ্য অসংখ্য নাটকীয় বাস্তব ঘটনাপঞ্জী! উপন্যাসটা পড়তে পড়তে চরমতম কট্টর মানুষও বুঝতে পারবে, পৃথিবীর ওই কঠিনতম সময়ে নবী মুহাম্মাদ সা: এর ইসলাম ই ছিলো মুক্তির একমাত্র উপায় ! অযুত নিযুত মানুষ জ্ঞাতসারে কিম্বা অজ্ঞাতসারে অপেক্ষা করছিলো মুক্তির সূর্য ইসলামের ।

চরম বিশৃংখল লন্ডভন্ড একটা পৃথিবী শুরু হয় বইয়ের শুরু থেকে । সেই বিশৃংখলা থেকে মুক্তি পেতে অথবা সেই বিশৃঙ্খলার স্রোতে গা ভাসিয়ে অসহায়ভাবে সাতরে চলতে চলতে গল্পের শেষটায় গিয়ে আবিষ্কার হয়, অলৌকিক এক বাস্তবতার । গল্পের নায়ক আসেম, যার উক্তি ছিলো, কখনো সম্ভব নয় এই ভূখন্ডে শান্তি আনবার, সে যখন জীবন নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে আরব থেকে বহু বহু দূরে, তখন আরবে ঘটে চলে অসংখ্য অভূতপূর্ব ঘটনা যা পাঠেরা আগেই জানে বলে এ উপন্যাসে একেবারেই আসেনি । আসেনি বলেই বড় আফসোস হয় আসেমের জন্য ! সে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে - রোম পারস্যের অসংখ্য ঝড়ঝাপ্টার অভিজ্ঞতা নিয়ে একসময়ে ফিরে আসে জন্মভূমিতে, এসে খুজে পায়না পুরোনো দিনের দেখে আসা আওস খাজরাজের কুটিল শত্রুতার লেশমাত্র!

সবাই বইটা পড়লে আমার বড় ভালো লাগবে । আমি যে আনন্দ পেয়েছি বইটা পড়ে, যে নতুনত্ব পেয়েছি, যে অদ্ভুত স্বাদ পেয়েছি, কেউ তা থেকে বঞ্চিত হোক, তা চাইনা ।

* * * * * * *

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

'আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ সা: এর পক্ষ থেকে ইরান সম্রাট কিসরার নামে। তাকে সালাম, যে হেদায়াতের অনুসরণ করে । আল্লাহ এবং তার রাসুলের উপর ঈমান আনার পর ঘোষণা করে যে আল্লাহ এক, একক । তিনি আমাকে সমগ্র বিশ্বের নবী করে পাঠিয়েছেন ।প্রতিটি মানুষকে তিনি আল্লাহর ভয় দেখাতে পারেন । যদি তুমি ইসলাম গ্রহণ কর শান্তি পাবে। আর যদি ফিরে যাও তবে প্রজাদের সকল দায় দায়িত্ব তোমার'

দোভাষী সম্রাটকে চিঠির ভাষা বুঝাচ্ছিলো । দরবারীদের হাসি চেপে রাখা ছিলো বড় মুশকিলের ব্যাপার । .....

* * * * * * * *

পারভেজ গ্লাস দেয়ালে ছুড়ে মারলেন। দারোগা তখন তাকে তার সেনাপতি সীনের মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকরীর খবর দিচ্ছিলো ।

: সে মানুষের সামনে আমার অপমান করেছে । তার চামড়া তোলার পূর্বে টেনে জিহবা ছিড়ে ফেলার উচিত ছিলো
: তাকে বেশিক্ষণ চিতকার করার সুযোগ দেয়া হয়নি ।
: আমার ব্যাপারে সে কি বলেছিলো ?
: ও বলছিলো আরবের এক নবীর ভবিষ্যঁবানী সত্য হবার সময় হয়ে এসেছে ।
:তোমার কথা আমি বুঝিনি..
: আলীজাহ! আরবের সে নবীর ভবিষ্যতবানী হলো কিছুদিনের মধ্যে রোমানরা বিজয়ী হবে! ধুলায় মিশে যাবে ইরানীদের জুলুমের হাত ।

* * * * * *

নীরবে উভয়ে পথ চলতে লাগলো । হঠাৎ থেমে আসেম বললোম, সরাইখানার ব্যবসায় আমি তৃপ্ত । আমি শুধু বেচে থাকতে চই।
:না, বর্তমানকে নিয়ে তুমি তৃপ্ত থাকতে পারোনা । আমার বিশ্বাস হঠাৎ তোমার বিবেক তোমাকে সচেতন করে তুলবে ।
: কস্তুনতুনিয়ার লাখো মানুষ ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আমি কিছু করতে পারি, আপনি আমায় কোনদিন বলেন নি ।
: শুধু অপেক্ষা করতে পারো আসেম, তাতারীদের রক্তের পিপাসা মিটাতে পারবেনা ওরা কেউ।


* * * * * * *

: ক্লেডিস ফ্রেমসের সাথে খানিক আলাপ করে আসেমের দিকে ফিরে বলল , আসেম, হেরাকলে আমরা খুব শিঘ্রী একটা মেলার আয়োজন করেছি । আমরা কস্তুনতুনিয়ার সব বন্ধুরা ওখনে চলে যাচ্ছি । কয়েকদিনের ভেতরে তুমিও চলে আসো ।

* * * * * * *

ওহ ! বলা হয়নি , গল্পের নায়িকার নাম ফুস্তিনা । টুকরো টুকরো কিছু কথোপকথোন তুলে দিয়ে আমি সবার আগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা করে গেলাম । জানিনা কতটা পেরেছি ।


* * * * * * *

আরবের নবীর ভবিষ্যৎবানী । যা তিনি করেছিলেন রোমানদের বিজয়ের ব্যাপারে অথচ ইরানীদের আক্রমনে বিশাল রোমান সাম্রাজ্য তখন শুধুমাত্র সবশেষ আশ্রয় কস্তুনতুনা গিয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পারভেজের করুনার ভিখারী হয়ে গিয়েছিলো । পেছন দিক থেকে তারা আক্রান্ত হত জংলী তাতারীদের । এসময়ে পারভেজ তার সেনাপতি সীন কে হত্যা করলো অন্যায়ভাবে । ঘুরে গেলো ইতিহাসের ভাগ্যের চাকা ...

আলিফ-লাম-মীম৷ রোমানরা নিকটবর্তী দেশে পরাজিত হয়েছে এবং নিজেদের এ পরাজয়ের পর কয়েক বছরের মধ্যে তারা বিজয় লাভ করবে৷ ক্ষমতা ও কতৃত্ব আগেও আল্লাহরই ছিল৷ পরেও তাঁরই থাকবে। আর সেদিনটি হবে এমন দিন যেদিন আল্লাহ প্রদত্ত বিজয়ে মুসলমানরা আনন্দে উৎফুল্ল হবে । আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী ও মেহেরবান৷ আল্লাহ এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, আল্লাহ কখনো নিজের প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধাচরণ করেন না৷ কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না৷ (সূরা আর-রূম : আয়াত ১-৬)

রোমানদের বিজয়ের সাথে সাথেই ৩১৩ জনের মুসলিম বাহিনীও বদরে বিজয়ী হয়ে অসম্ভব সে ভবিষ্যৎবানীকে সত্যে পরিনত করে চমকে দিলো বিশ্ববাসীকে । চমকে দিলো ইতিহাসকে । বইটা পড়লেই বুঝা যাবে, এ ভবিষ্যৎবানী কতটা উদ্ভট আর হাস্যকর মনে হবার কথা ছিলো...

লিখেছেন- স্বর্ণলতা @ সোর্স লিঙ্ক 

No comments:

Post a Comment