নারীর চাকুরি নাকি সংসার? এই বিতর্কের অবসান ঘটান

আমার মা একজন গৃহিণী। আমার ২১ বছরের জীবনে খুব কমই তাঁকে বিশ্রামরত অবস্থায় দেখেছি। সেই ভোরবেলা থেকে তাঁর সংগ্রাম শুরু হয়, যা গভীররাতে গিয়ে থামে। আমাদের চার ভাইবোনকে বলতে গেলে তিনি একা হাতে মানুষ করেছেন। বাবা অফিস করতেন, আর বাসায় বিশ্রাম করতেন। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা এবং অন্যান্য বিষয়াদি সম্পর্কে তিনি খুব বেশি ওয়াকিবহাল ছিলেন না। এ ব্যাপারে বলতে গেলে পুরো দায়িত্বই ছিল মায়ের উপর। আমি জোর গলায় বলতে পারি সন্তানদের প্রতি তিনি যতটা কেয়ার নিয়েছেন এবং সময় দিয়েছেন খুব কম মা ই এতটা শ্রম দিতে পারেন।

প্রায় সারাটা জীবন তিনি সংসারের পেছনে এতটা শ্রম দেওয়ার পরও রোকেয়া প্রাচীদের ভাষায় তিনি কোন কাজ করেননি, 'ঘরে বসে ছিলেন'। কেন? কারণ তাঁর শ্রমের বিনিময়রূপ তিনি কোন অর্থ পান নি। কর্পোরেট দুনিয়া আমাদের আজ শেখায়, সেটাই হল "কাজ" যার দ্বারা অর্থ উপার্জন করা যাবে। কাজেই নারীদের "ঘরে বসে থাকা" দূর করতে তারা শেখালো পুরুষের মত মেয়েরাও বাইরে কাজ না করলে তাদের মর্যাদা নেই। তাই আমার মা'র সারাজীবনের পরিশ্রম এদের কাছে মূল্যহীন, কিন্তু যে নারীরা পণ্যের মডেল হয়ে দুটো টাকার বিনিময়ে শরীর দেখায়, তারা "কর্মজীবী" নারী !! একজন নারী নিজ সংসারের দায়িত্ব পালন করলে সেটা 'শ্রম' না, কিন্তু অন্যের বাড়িতে ক'টা টাকার বিনিময়ে কাজ করে বাড়ির মালিকের গালি শুনলে সেটা হয় "শ্রম" !!

সমাজের ভারসাম্য সেইদিন নষ্ট হয়েছে, যেদিন মেয়েদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে পুরুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক সহযোগিতার নয়, প্রতিযোগিতার। মেয়েদের শেখানো হল তাদের "পুরুষ" হওয়ার চেষ্টা করতে হবে, নইলে কোন দাম নেই। নারীর সম্মান "নারীত্বে" নয়, "পুরুষত্বে", পুরুষের অনুকরণ করার মধ্যেই নারীর সম্মান। পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতা না করলে নাকি সমাজে টেকা যাবে না। সেই প্রতিযোগিতার নাম দিয়ে মেয়েদের রাস্তায় নামিয়ে পণ্য বানানো হল। বিজ্ঞাপনের মডেল বানিয়ে ভোগের বিপনন হল। পুরুষের শেভিং ক্রিমের বিজ্ঞাপনে অপ্রাসঙ্গিকভাবে স্বল্পবসনা নারীর উপস্থিতি কীভাবে নারীর সম্মান বৃদ্ধি করে, আমার মাথায় ঢুকে না। তীব্র শীতের মধ্যেও পুরুষের চোখে কমনীয় হতে কাপড় না খুললে নারীরা যেখানে দাম পায় না, সেই পাশ্চাত্য সমাজ যখন মেয়েদের অধিকার আর মর্যাদার মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেয়, তখন এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। মুখে 'আত্মনির্ভরশীলতার' বুলি ফুটিয়ে পুরুষের "কামনা পূরণের ম্যাটেরিয়াল" হিসেবে ধরিয়ে দিয়ে এরা নিজেদের ব্যবসার মূলধন যোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

ইসলাম নারীদের মর্যাদা নির্ধারণ করেছে স্ত্রীত্বে, মাতৃত্বে; পুরুষের অনুকরণ করার মধ্যে নয়। ইসলামে নারী ও পুরুষ পরস্পরের পরিপূরক, প্রতিযোগী নয়। একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। দুজনের ক্ষেত্র পৃথক, সম্মানের মানদণ্ডটাও পৃথক। সমানাধিকারের নামে নারী-পুরুষ উভয়কে অপমান করার প্রথার এখানে জায়গা নেই।

ইসলাম নারীদের হিজাব পালন করে হালাল রুজি অনুসন্ধানে বাধা দেয় না। কিন্তু ইসলাম নারীবাদীদের মত কখনোই বলে না, বাইরে কাজ করার মধ্যেই মেয়েদের সম্মান নিহিত। ইসলামে সর্বোচ্চ সম্মানিত চারজন নারীর কেউই ব্যবসা বা আউটডোর ওয়ার্কের জন্য এ মর্যাদা পান নি, বরং একজন মা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে বা কন্যা হিসেবে পূর্ণরূপে দায়িত্ব পালনেই এ সম্মানের অধিকারিণী হয়েছেন।

সমাজে পুরুষ আর নারীর রোলের তুলনাটা Nazmus Sakib ভাই চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন ফুটবল দলের মাধ্যমে। একটা ফুটবল দলে গোলকিপার, ডিফেন্ডার, স্ট্রাইকার সবাই থাকে এবং সবার আলাদা আলাদা দায়িত্ব আছে। এখন আপনি বলতে পারবেন না কার কাজটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আর কারটা কম। এখন আপনি গোলকিপারকে স্ট্রাইকারের জায়গায় বসিয়ে স্ট্রাইকারকে গোলকিপিং করতে দিয়ে কি জেতার আশা করতে পারেন? কিংবা স্ট্রাইকার যদি বলে-"আমাকে গোলকিপিং করতে না দিয়ে আমার অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে" তাহলে কি যুক্তসংগত দাবি হবে? তেমনি নারী-পুরুষের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও তাদের সকল দিক থেকে "সমান" বানানোর প্রচেষ্টা কি সমর্থনযোগ্য? এতে কি উভয়কেই অসম্মান করা হচ্ছে না?

একজন মা তার সন্তানকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র কাছে যে সম্মানের অধিকারিণী হন, বাইরে চাকরি করে কস্মিনকালেও সেটা পাবেন না। আবার বাইরে কাজে বেশি সময় দেওয়ায় যদি সন্তান তার হক্ব থেকে বঞ্চিত হয়, তবে তাকে জবাবদিহি করতে হবে আল্লাহ্‌র দরবারে। বাইরে কাজ করতে নিষেধ নেই বটে, কিন্তু সেটার প্রতিই বেশি জোর দেওয়ায় যে আমাদের সমাজের কত নারী নিজ পরিবারের প্রতি দায়িত্বে অবহেলা করে গুনাহগার হচ্ছেন, তা আমরা হিসাব করে দেখছি কি?

অনেকে আপত্তি জানিয়ে বলবেন, কিন্তু এমন অনেক ক্ষেত্র আছে, যেখানে মেয়েদের কাজ করা আবশ্যক। যেমন গাইনির ডাক্তার, নার্স, শিক্ষকতা ইত্যাদি।

কথাটা অবশ্যই সত্য এবং আমি তা বিশ্বাসও করি। আমি এক্ষেত্রেও ফুটবলের উদাহরণটা টানব। একজন ডিফেন্ডারের প্রধান কাজ গোল বাঁচানো এবং স্ট্রাইকারের কাজ গোল দেওয়া, তার মানে কি এমন যে স্ট্রাইকার গোল সেভ করতে বা ডিফেন্ডার গোল দিতে পারবেন না? বরং অনেকসময় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে এটাই আবশ্যক হয়ে পড়ে। যেমন একজন ডিফেন্ডার যদি প্রতিপক্ষের গোলমুখে বল পেয়ে যান, তখন কি তিনি স্ট্রাইকারকে বল দেওয়ার অপেক্ষা করবেন? তাহলে তো গোল মিস হয়ে যাবে। আবার একজন স্ট্রাইকার যদি নিজের দলের ডি বক্সে থাকেন আর তখন প্রতিপক্ষ আক্রমণ করে, তিনি কি সেভ করার চেষ্টা করবেন না? বরং সেটা না করলেই বিপদ। কিংবদন্তি ডিফেন্ডার রবার্তো কার্লোস বেশকিছু গোল করেছেন আবার মেসিও অনেক সেভ করেছে। তারমানে কিন্তু এই না যে আমরা কার্লোসকে গোল করা বা মেসিকে গোল সেভের জন্য মনে রাখব।

তেমনি অনেক পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ আবশ্যক বটে, কিন্তু তার মানে এই না যে ঐসকল পেশাই নারীদের প্রকৃত মর্যাদার জায়গা। আসলে সেক্যুলার সমাজ পরিবারের প্রতি নারীদের পবিত্র দায়িত্ব পালনকে কোন কাজ হিসেবে গণ্য করে না, নারীরা যেন তাদের কথামত চলে এই আশায়। নারীদেরকে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থাপন করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে, আর আমরাও নিজেদের বিবেক-বুদ্ধিকে কাফিরদের কাছে বন্ধক রেখে মেয়েদের সম্মান দেওয়ার নামে নারী-ব্যবসায়ীদের হাতের পুতুল করে ছেড়ে দিচ্ছি।

আল্লাহ্‌ আমাদের মাফ করুন এবং নিজ নিজ সম্মানের প্রকৃত ক্ষেত্র উপলব্ধির সামর্থ্য দান করুন

collected from
brother
Jubaer Hossain

No comments:

Post a Comment