ঈদুল আযহার পূর্বে কিছু প্রশ্ন

প্রতি বছর ঈদুল আযহার পূর্বে কিছু প্রশ্ন আশপাশ থেকে ভেসে আসে। সহজ ভাষায় সেরকম দুটো প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।

প্রশ্ন ১. কুরবানীর ঈদকে কেন্দ্র করে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়। এই টাকাটা অন্য কাজে লাগালে হ্যান হত ত্যান হত ইত্যাদি।

উত্তর: কুরবানীর ঈদকে ঘিরে অনেক বেশি অর্থ সঞ্চালন হয়। যা যে কোনো অর্থ ব্যবস্থার জন্যই হট-কেকের মত। একটি অর্থ ব্যবস্থায় যত বেশি অর্থের আদান-প্রদান হয়, সেটাকে তত শক্তিশালী মনে করা হয়।

কুরবানী ঈদকে টার্গেট করে একদল মানুষ গুরু-মহিষ-উট-ছাগল-ভেড়া-দুম্বা প্রতিপালন করে। ঈদের আগে তারা বিক্রয় করে। অপর দল সেগুলো গরুর হাটে নিয়ে আসে। কখনো বা মালিক নিজেই গরুর হাটে আনেন। পরিবহন শ্রমিক-ব্যবসায়ীরা গরু-ছাগল পরিবহন করেন। (পথিমধ্যেও কিছু মানুষের উপার্জনের ব্যবস্থা হয়, হারাম উপায়ে, ঘুষ হিসেবে।)

একদল লোক হাটের ব্যবস্থা করেন। সেখানে বাঁশ, বিদ্যুৎ, পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে আরে অনেকের কর্মসংস্থান হয়। গরু-ছাগলের খাবার, দা-বটি-চাটাই -এসব নিয়েও একদল মানুষ ব্যবসা করেন। সবশেষে গরু-ছাগল ক্রয় করেন কুরবানীদাতা।

কুরবানী করার পর চামড়া ছাড়ানো-গোস্ত বানানো ইত্যাদির জন্য একদল মানুষের কর্মসংস্থান হয়। চামড়া আবার চলে যায় গরীবের কাছে। সে আবার বিক্রয় করে ট্যানারির কাছে। ট্যানারি প্রতিষ্ঠান তা পরিশোধন করে বিদেশে এক্সপোর্ট করেন। এত মানুষের আয়-কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশ উপার্জন করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। কুরবানীর বর্জ্য অপসারণেও কর্মসংস্থান হয় অনেকের।

এ তো গেল কুরবানীর পশুকে ঘিরে এত কিছু। এছাড়া ঈদের আনন্দকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পোশাক-পরিচ্ছদসহ নানা কিছুর ক্রয়-বিক্রয় হয়। নগদ অর্থের বিরাট এ লেনদেন সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নতুন নোট ছাপাতে হয়। ব্যাংকগুলোতে প্রচুর লেনদেন হয়ে থাকে। এক কথায়, এই একটি ইবাদতকে কেন্দ্র করে প্রচুর অর্থের লেনদেন হয়, কর্মসংস্থান হয় লাখো মানুষের।

এছাড়া আর্থিক লেনদেনের উদ্দেশ্য শান্তি। এই দিনকে ঘিরে ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবার ঘরে ঘরে আনন্দ বয়ে যায়। সবাই গোশত খেতে পারে।

অন্য ধর্মে লাখ-লাখ টাকার মূর্তি বানিয়ে পুজো দিয়ে তা পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। সেটা নিশ্চিতভাবেই আর্থিক ক্ষতি। কারণ, তাতে মূল্যবান একটি জিনিস চূড়ান্ত ব্যবহার ছাড়াই নষ্ট করে দেয়া হয়।

পক্ষান্তরে কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য "আল্লাহকে খুশী করা" হওয়া সত্ত্বেও এর গোশত নিজে খাওয়া, গরীব ও আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। কাজেই কুরবানীতে কোনো অপচয় নেই। এমনকি এর চামড়া চলে যাচ্ছে গরীবের কাছে, এর দ্বারাও উপকৃত হচ্ছে মানুষ।

প্রশ্ন ২: এতে পশুর অধিকার নষ্ট হয়।

উত্তর: পশুর অধিকার কীভাবে রক্ষা হবে আর কীভাবে তা নষ্ট হবে, তা পশুর স্রষ্টাই ভালো জানেন। মানুষের অধিকার রক্ষা হয় তার ঈমান, সম্মান, সম্পদ, মেধা ও বংশ রক্ষার মাধ্যমে। পক্ষান্তরে পশুর অধিকার রক্ষা হয় তাকে হালালভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে। যেসব প্রাণী খাওয়া হালাল, সেগুলো খাওয়ার মাধ্যমেই তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়।

উপরন্তু রাসূল স. সকল ক্ষেত্রে ইহসান চর্চা করতে বলেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ সবকিছুতে ইহসান পছন্দ করেন। কাজেই তোমরা যখন যবেহ করবে, সুন্দরভাবে যবেহ করবে। তোমাদের প্রত্যেকে যেন যবেহের পূর্বে ছুরি ধার করে নেয়।

অনুরূপভাবে এক পশুর যবেহের সময় আরেক পশুকে তা দেখানোকে অপছন্দ করা হয়েছে। এসবই পশুর প্রতি সর্বোচ্চ মায়া-মমতা প্রদর্শনের জন্য।

কিন্তু যে জায়গায় পশুর স্রষ্টা স্বয়ং একটি নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে তা লঙ্ঘন করে প্রেম দেখানো মুনাফিকী ও ভেজাল প্রেম, খাঁটি প্রেম নয়।

তাছাড়া যারা পশু প্রেমের কথা বলেন, দেখা যায়, তারা পিজা, কেএফসি, বিরিয়ানি ইত্যাদি খুব পছন্দ করেন। যেগুলোতে যে কোনো প্রাণীর গোশত থাকেই। আবার বিজ্ঞানীদের মতে উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। কাজেই ভেজিটেরিয়ানরাও দায় এড়াতে পারেন না।

সবচেয়ে সম্মানিত প্রাণী, মানুষ, যখন দেদারে প্রাণ দেয়, তখন অবশ্য পশু-প্রেমিকদের প্রেম সুপ্ত থাকতেই বেশি দেখা যায়।

---

শেষকথা, কুরবানী একটি মহান স্মৃতিকে বারবার সামনে নিয়ে আসে। ইবরাহীম ও ইসমাইল আ. এঁর সেই ঘটনার মূল শিক্ষা অদৃশ্য সত্ত্বা আল্লাহর প্রতি অগাধ ঈমান। ঈমান কতটুকু মজবুত হলে অদৃশ্য একজনের নির্দেশ বাস্তবায়নে নিজের সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে (সেসময় একমাত্র সন্তান, যাকে তিনি পেয়েছেন বার্ধক্যে, যৌবনে নয়) ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন!

আল্লাহ তায়ালা আমাদের কাছ থেকে সেই ঈমানটিই চান। কুরবানী কেন করব, এরকম প্রশ্ন ছাড়াই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে কুরবানী করতে সচেষ্ট হব আমরা। যে কোনো ইবাদতই বিনা প্রশ্নে করব। এটাই ঈমান। তাকওয়া এরই নাম।

আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের কাতারে শামিল করুন। আমীন।

- ইউসুফ সুলতান

No comments:

Post a Comment